



শৌভিক দাস : শেক্সপিয়ার বহুকাল আগেই বলে গেছেন, “নামে কী আসে যায়? গোলাপ কে যে নামেই ডাকা হোক তা মিষ্টি গন্ধ ছড়াবেই।” বাস্তবিক, নামে কিছু আসে যায় না। সেই কারণে “রাজা” নামধারী অনেকেই দু’বেলা দু’মুঠোর জন্য প্রাণপাত করে আর “ফকিরা” নাম নিয়েও কেউ কেউ আবার টাকার গদিতে পাশ ফিরে শোয়। তাই নামে যে “জিরো” আদপে সে যে জিরো নয় সে কথা আর বুঝিয়ে বলতে হয় না। কিন্তু “জিরো” কি কারোর নাম হতে পারে!? আরে মশাই এই মহাবিশ্ব জগতে কি হয় আর কি হয় না তার শেষ কি কেউ দেখেছে না জানে? ছোটবেলা থেকে বাপের কাছে ভর্ৎসনায় “অপদার্থ” ডাক শুনতে শুনতে মানুষ এবেলায় তা আবিষ্কারও করে ফেলল আর তার তুলনায় “জিরো” নাম তো সাধারণ ব্যাপার।
আছে আছে “জিরো” নামও আছে। তবে এ জিরো আর্যভট্ট প্রসূত শূন্য বা জিরো নয়। ইংরেজি বানানেও ফারাক আছে “Ziro”। আমাদের দেশের উত্তর-পূর্বের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের এক শহরের নাম হলো এই “জিরো”। এই জায়গা সম্পর্কে যাঁরা জানেন তারা তো জানেনই, কিন্তু যাঁরা জানেননা তাঁদের জন্যই এই লেখা।এর আগেই শেক্সপিয়ারের দিব্যি দিয়েছি তাই আপনি মানতে বাধ্য যে “জিরো” নামের এই জায়গা একেবারেই জিরো বা শূন্য নয়। তবুও কোনো কোণায় পাঠকের মধ্যে যদি এক-দু’জন শেক্সপিয়ার নাস্তিক থেকে থাকেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, “ইউনাইটেড নেশনস এডুকেশনাল, সাইন্টিফিক এণ্ড কালচারাল অর্গানাইজেশন” এককথায় “ইউনেস্কো”-র নেক নজরে রয়েছে এই জায়গায়টি। আশা করা যায় খুব শিঘ্রই “জিরো” ইউনেস্কো দ্বারা “ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট”-এর মর্যাদা লাভ করবে।
মালুম হয় এবার অনন্ত তাদের নাক সিটকানি কমেছে যারা যুগোপযোগী হওয়ার জন্য “সিদ্ধার্থ” থেকে “Seed” হয়েছেন বা ওই গোছের। জানিনা ইংরেজিতে বানানটা ভুল লিখলাম কিনা তবে লিখতে গিয়ে স্বকীয় ভাবে এই বানানটাই এলো। এই হয়েছে আমার এক জ্বালা। লিখতে বসি “তার” হয়ে যায় “বিস্তার”। যাইহোক লেখায় আর মেদ না বাড়িয়ে চটি পায়ে চটপট বিষয়ে ঢুকে পড়ি। ভারতের অরুণাচল প্রদেশের লোয়ার সুবানসিরি জেলার জেলা সদর এই “জিরো” শহর। অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর থেকে প্রায় ১১৫ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে পাহাড়ে ঘেরা এই জায়গা এখনও বেশিরভাগ মানুষের কাছেই অল্প পরিচিত বা অপরিচিত। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬৭৬ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত জিরো উপত্যকা সুন্দরী অরুণাচলের অন্যতম নয়নাভিরাম স্থান। চারিদিকে ধুম্র নীলাভ ধ্যানস্থ পাহাড়ের মাঝে বিস্তীর্ণ উপত্যকায় চাষের জমির সবুজ যেন মোলায়েম গালিচা বিছিয়ে রেখেছে এখানে।
তার সাথে মেঘে-নীলে আকাশের সুচারু সঙ্গতে সৃষ্ট কমনীয় সৌন্দর্য আধুনিক শহুরে জীবনযাপনে ক্লান্ত অবসন্ন শরীর-মনে সুখ সংগীতের দীর্ঘস্থায়ী অনুরণন সৃষ্টি করে। এক লহমায় কিশলয় হয়ে ওঠে মন এখানকার আরামপ্রদ জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশে। সারা বছরই এখানকার জলবায়ু বেশ আরামদায়ক থাকে। তাই এখানে ঘুরতে বছরের যেকোনো সময়ই আসা যেতে পারে। প্রাকৃতিকভাবে ছবির মতো সুন্দর এই জায়গা আরও বিশেষ হয়ে পড়ে এখানকার “আপাতানি” জনজাতির মানুষজনের আতিথেয়তায়। তাদের ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ধরন “জিরো”-কে ফটোগ্রাফারদের কাছে অনায়াসেই করে তুলতে পারে স্বর্গরাজ্য। গত ২০১২ সাল থেকে প্রতিবছর আপাতানি জনজাতির আয়োজনে এখানে “জিরো মিউজিক ফেস্টিভ্যাল” অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবছর কয়েক দিন আগে সেপ্টেম্বরেই হয়ে গেল সেই “ফেস্টিভ্যাল”। এই সংগীত উৎসবে দেশবিদেশের নানান সংগীত শিল্পী অংশগ্রহণ করতে আসেন। তাই এই “ফেস্টিভ্যাল”-এর সময় এখানে বেড়াতে আসতে পারলে আপনার “জিরো” ভ্রমণে তা যে আলাদা একটা মাত্রা যোগ করবে সেটা বলাই বাহুল্য।
যোগাযোগ :
জিরো শহরে পৌঁছোতে আপনি যোগাযোগের যেকোনো মাধ্যম ব্যবহার করতে পারেন। আপনি যদি অরুণাচলের রাজধানী ইটানগর পৌঁছে যান তবে সেখান থেকে “জাতীয় সড়ক ২২৯” সহ “হোজ-পোটিং” রোড ধরে জিরো পৌঁছাতে সময় লাগে প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টার মতো। এছাড়া আপনি যদি সরাসরি জিরো পৌঁছাতে চান তারও ব্যবস্থা আছে। অরুণাচল প্রদেশের রাষ্ট্রীয় পরিবহণ সংস্থার নাইট সার্ভিস বাসে গুয়াহাটি থেকে সরাসরি জিরো আসা যেতে পারে। তবে এই পরিষেবা কিন্তু সপ্তাহে শুধুমাত্র চারদিনই চালু থাকে। এবারে আসি রেল যোগাযোগের বিষয়ে। ট্রেনে যেতে চাইলে আপনাকে যেতে হবে জিরোর সবচেয়ে কাছের স্টেশন “নাহারালাগুন”-এ জিরো থেকে যার দূরত্ব ১০০ কি.মি.। অথবা যেতে পারেন জিরো থেকে ১১৭ কি.মি. দূরে অবস্থিত “উত্তর লখিমপুর” স্টেশনে। সেখান থেকে আপনাকে শেয়ার ট্যাক্সি অথবা গাড়ি ভাড়া করে আসতে হবে জিরো। গুয়াহাটি স্টেশন থেকে “ডনি পোলো এক্সপ্রেস” (১৫৬১৭) প্রতিদিন নাহারালাগুন স্টেশনে যাতায়াত করে। আর সোম-বুধ-শুক্র এই তিনদিন রয়েছে গুয়াহাটি-নাহারালাগুন শতাব্দী এক্সপ্রেস (১২০৮৮)। এছাড়া সপ্তাহে বৃহস্পতি এবং রবিবার দিল্লীর “আনন্দ বিহার টার্মিনাল” স্টেশন থেকে “নাহারালাগুন” পর্যন্ত চলে “অরুণাচল এক্সপ্রেস” (২২৪১২)। অন্যদিকে, “কামাক্ষা” স্টেশন থেকে “উত্তর লখিমপুর” স্টেশনে দৈনিক যাতায়াত করে “লচিত এক্সপ্রেস” (১৫৬১৩)। আকাশ পথে এখানে আসতে হলে আপনি আসতে পারেন জিরো থেকে ৯৮ কি.মি. দূরে অবস্থিত আসামের জোরহাট এয়ারপোর্টে। এটাই জিরোর সবচেয়ে কাছের বিমান যোগাযোগ ব্যবস্থা। এছাড়াও ১২৩ কি.মি. দূরে রয়েছে লিলাবাড়ি এয়ারপোর্ট এবং গুয়াহাটি ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট যা জিরো থেকে ৪৪৯ কি.মি. দূরে অবস্থিত।
থাকার ব্যবস্থা :
বেশ কয়েকটি থাকার জায়গা রয়েছে জিরো-তে
“জিরো ভ্যালি রিসর্ট” (ফোন – 08794111856)
“অরুণাচল গেস্ট হাউজ” (ফোন – 08794668775, 08730946466)
“হোটেল সেন্টার পয়েন্ট” (ফোন – 09615836679)
“সিরো রিসর্ট” (ফোন – 9615298679)
“জিরো প্যালেস ইন” (ফোন -096129 14294)
যেহেতু আজও এই জায়গা প্রচারের আলো বিশেষ পায়নি তাই এখানে এখনও পর্যটকদের ভিড় বেশ কম। সেই কারণে প্রকৃতিপ্রেমিক, ফটো শিকারি, সংগীত তথা শিল্পপ্রিয় বাঙালি পর্যটকদের কাছে জিরো অচিরেই হয়ে উঠতে পারে প্রিয় বিচরণভূমি। তাই এককথায় বলা যেতেই পারে শহুরে ব্যস্তার থেকে রেহাই নিয়ে অপরূপ প্রকৃতির সান্নিধ্যে শরীর ও মনকে সতেজ করতে “জিরো” একটু জিরিয়ে নেওয়ার অন্যতম সবচেয়ে আদর্শ জায়গা। আর সেই দ্যোতনাই যেন নামের মধ্যে অন্তর্নিহিত করে রেখেছে সুন্দরী “জিরো”।
#অরুণাচল#জিরো
