



#কৌশিক চট্টোপাধ্যায় : দুদিকের নানারকম গাছের সারিকে পেছনে ফেলে আমাদের নিয়ে কালো রাস্তার বুক চিড়ে গাড়ী এগিয়ে চলছে জঙ্গলের পথ ধরে । ঘড়িতে তখন সবে মাত্র বিকেল সাড়ে চারটা, অথচ এর মধ্যেই সন্ধ্যে নেমে এসেছে ডুয়ার্সের আনাচেকানাচে। রাস্তার দুই ধারের দিগন্ত বিস্তৃত জঙ্গলের ঝোপেঝাড়ে মাকড়শারজালের মতো জমাট বাঁধতে শুরু করেছে গাঢ় অন্ধকার। গাড়ীর মিউজিক সিস্টেম চলছে গুপি বাঘার সেই গান – ‘ এ যে দৃশ্য দেখি অন্য, এ যে বন্য, এ অরণ্য ‘ গোটা শরীরের ভেতর দিয়ে কেমন যেন একটা ছমছমে হিমেল স্রোত বয়ে গেলো।

নাম না জানা ঘণ্টা পোকার অবিশ্রান্ত আওয়াজ, জঙ্গলের অন্ধকারে আটকে থাকা জমাট কুয়াশা আর একের পর এক বিপদজনক অ্যানিম্যাল করিডর পার হতে হতে ধমনীতে বয়ে চলা রক্তস্রোতের তাপমাত্রাকে আরো নামিয়ে দিচ্ছিলো মিউজিক সিস্টেমের থেকে বেড়িয়ে আসা সেই গান ‘হেথা দিনেতে অন্ধকার, হেথা নিঃঝুম চারিধার’। জঙ্গলে প্রতিটি রন্ধ্রে যেনো শিকারির মত ওতপেতে আছে ভয়। যখন তখন বুনো দাঁতাল বা বাইসনের মুখোমুখি হয়ে যাওয়ার ভয় মেশানো আনন্দ। গোটা ভারতবর্ষের যতগুলি অভয়ারণ্য আছে তার মধ্যে ডুয়ার্সের অভয়ারণ্য গুলি অন্যতম। এখানে হিমালয় পর্বতের পাদদেশে তরঙ্গায়িত ভুমিঢালের চা বাগিচা আর ঘন জঙ্গলে হাতি, বাইসন, গণ্ডার, চিতা বাঘের আবাসস্থল। নাম না জানা রঙবেরঙের পাখি, পেখম মেলা ময়ূর আর ধান পাকার সময় হলেই এখানে যত্রতত্র দেখা যায় বুনো হাতির পাল। নিউজ বৃত্তান্তের ভ্রমণ প্রেমীদের জন্য রইলো ডুয়ার্সের কয়েকটি অবশ্য গন্তব্যের সুলুকসন্ধান –
II জলদাপাড়া II
ডুয়ার্স ভ্রমণের কথা উঠলেই প্রথমেই এসে যায় জলদাপাড়ার নাম। বুড়ি তোর্সা, তোর্সা,কালিঝোরা, হলং নদীর চারপাশে শাল,শিশু,গামার, খয়েরের ঘন জঙ্গলে দেখা মিলতে পারে চিতল,গাউর,সম্বর, বুনো হাতির দলের। নলখাগড়ার ঘাস জমিতে মিলতে পারে ডুয়ার্সের বিখ্যাত একশৃঙ্গ গণ্ডারের। সব মিলিয়ে আপনার ডুয়ার্স সফর জলদাপাড়া থেকেও শুরু করতে পারেন।

কিভাবে যাবেন : শিয়ালদা থেকে ১৩১৪৯ কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস করে হাসিমারা স্টেশনে এসে নামুন। এখান থেকে ১২ কিলোমিটার গাড়িতে করে পৌঁছেযান মাদারিহাট। মাদারিহাটকেই জলদাপাড়া অভয়ারণ্যের প্রবেশ পথ বলে। আর যদি হলং বনবাংলো যেতে চান তবে আরো ৮ কিলোমিটার জঙ্গলের মধ্যদিয়ে যেতে হবে আপনাকে।

II গরুমারা জাতীয় উদ্যান ( লাটাগুড়ি)II
মালবাজার,চালসা হয়ে পৌঁছে যেতে পারেন লাটাগুড়িতে। দুপাশে চায়ের বাগান শেষ হলেই বেশ কয়েক কিলোমিটার জঙ্গলের পথ পেরিয়ে গরুমারা জাতীয় উদ্যান। তবে জঙ্গলের পথ পেরোনোর সময় খুব সাবধান। একেরপর এক অ্যানিমেল পাসিং করিডোর দিয়ে আচমকা সামনে এসে যেতেই পারে বুনো হাতির পাল অথবা এক পাল বাইসন। এখানে দিন দুয়েক থেকে জীপ সাফারি করে দেখে নিতে পারেন – যাত্রাপ্রসাদ,চুকচুকি,চন্দ্রচূড়,মেদলা,রাইনোপয়েন্ট ওয়াচটাওয়ার। সাফারি করার জন্য খুব সকালে টিকিট কাউন্টারে গিয়ে লাইন দেওয়া প্রয়োজন। ভাগ্য ভালো থাকলে দেখা মিলতেই পারে গণ্ডার, হাতি,বাইসন অথবা নানান রঙের ময়ূরের। সারাদিন চারটি পর্বে জঙ্গল সাফারি হয়ে থাকে।

কিভাবে যাবেন : শিয়ালদা বা হাওড়া থেকে যে কোন ট্রেনে মাল জংশন। সেখান থেকে গাড়িতে করে লাটাগুড়ি। আবার জলপাইগুড়ি, ময়নাগুড়ি হয়েও যাওয়া যায়।
কোথায় থাকবেন : ড্রিম ল্যন্ড হোটেল, ভাড়া ২৫০০ – ৩০০০ বুকিং www.wbfdc.com
হর্নবিল নেস্ট – ভাড়া ৭২০ – ১৭০০ টাকা, বুকিং www.dooarstours.com. অরণ্য রিসোর্ট – ভাড়া ১২০০ – ২০০০ টাকা ফোন – 033 3053- 3974
II কালিপুর ইকো ক্যম্প II
ডুয়ার্সের ঘন জঙ্গলে একটি স্মরণীয় রাত কাটাতে চলে যেতে পারেন লাটাগুড়ি থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত কালিপুর ইকো ক্যাম্পে। প্রথমে বিস্তীর্ণ ধান ক্ষেত এবং তার পরে চা বাগানের মধ্যদিয়ে পৌঁছে যান কালিপুর ইকো রিসোর্টে। চা বাগান আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা রিসোর্টে গা ছম ছমে একটি বুনোরাত আপনার সারাজীবনের স্মৃতির সঙ্গী হয়ে থাকবে। কয়েক পা হেঁটেই চলে যেতে পারেন মেদলা ওয়াচ টাওয়ারে। ইকো ক্যাম্পের অতিথিদের জন্য কোন প্রবেশ মূল্য লাগেনা। রাতে আদিবাসী নৃত্য আর কাকভোরে হাতির পিঠে চেপে মূর্তি আর জলঢাকা নদী পেড়িয়ে ঘুরে আসুন ঘাসের বনে গণ্ডারে বিচরণ ভূমিতে। ২৪ ঘন্টার প্যাকেজে আস্ত একটি অরণ্য ভ্রমন আপনার ভালো লাগবেই।

কিভাবে যাবেন : মাল স্টেশনে নেমে চলে আসুন লাটাগুড়ি অথবা মাল স্টেশন থেকেই সরাসরি গাড়ি ভাড়া করে চলে যেতে পারেন কালিপুর ইকো ক্যাম্পে।
কোথায় থাকবেন : থাকার খরচ দুজনের জন্য ৩৩০০ টাকা, তিন জনের জন্য ৪৩০০ টাকা। এর মধ্যে থাকা, খাওয়া,আদিবাসী নৃত্য,হাতি সাফারির খরচ ধরা রয়েছে। বুকিংয়ের জন্য যোগাযোগ করুন, ০৩৫৬১- ২৬৬৩৪০
II বরদাবাড়ি II
হাসিমারা থেকে খুব কাছে শাল,সেগুন আর গামারের জঙ্গলে ঘেরা অরণ্য ঠিকানা বরদাবাড়ি। এখানে মালঙ্গি বনবাংলোয় কাটাতে পারেন একটি দুটি রাত্রি। বন বাংলোর ঠিক পেছনেই এলিফ্যান্ট রাইডিং পয়েন্ট । টিকিট কেটে চড়ে বসুন হাতির পিঠে আর ক্যামেরা তৈরি রাখুন আচমকা চোখে সামনে চলে আসা গণ্ডার বা বুনো হাতির পালের ফাস্ট ক্লিকের জন্যে।

কোথায় থাকবেন : এখানে রাত্রিযাপনের একটাই ঠিকানা পশ্চিম বঙ্গ বন উন্নয়ন নিগমের মালঙ্গি বন বাংলো । ভাড়া ১৪০০ – ২০০০ টাকা। বুকিং www.wbfdc.com
II ২৮ মাইল II.
আলিপুরদুয়ার থেকে পাক্কা ২৮ মাইল দুরের অবস্থিত এই জংলী গ্রামের নাম ২৮ মাইল। একদিকে বালা নদী অন্যদিকে সামান্য দূরে জয়ন্তী নদী। এখান থেকে সামান্য পাহাড়ি পথ পেরিয়ে দেখে নিতে পারেন বক্সা দূর্গ। লোকাল ট্যুরে ঘুরে দেখতে পারেন জয়ন্তী। দূরে ঢেউ খেলানো ভুটান পাহাড় আর জ্যোৎস্না রাতে ডলোমাইটে সাদা জয়ন্তী নদীর বুকে খাসি পাহাড়ের মায়াবী ছায়া সে এক স্বপ্নের দেশে পৌঁছে দেবে আপনাকে।

কিভাবে যাবেন : শিয়ালদা থেকে ১৩১৪৯ কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে আলিপুরদুয়ার সেখান থেকে গাড়িতে পৌঁছে যান ২৮ মাইল।
কোথায় থাকবেন : একটাই হোমস্টে। থাকা খাওয়া জনপ্রতি ৪০০ টাকা। যোগাযোগ – ০৩৫৬৪- ২০৩১৯৬, ৯৭৭৫৮২৭৭৫৬
