



#হাবিবুর রহমান, ঢাকা: ইউক্রেনের মারিউপোলের আকাশে গোলা ও নিচে নির্বিচারে চলছে গুলি। থেকে থেকে হচ্ছে বিস্ফোরণ। কেঁপে উঠছে ইউক্রেনের মাটি। মুহূর্তে তছনছ হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি। চোখের সামনে পুড়ছে সব। কান্নার রোল চারদিকে। ধ্বংসস্তূপের মধ্য থেকে ধ্বনিত হচ্ছে চিৎকার। কেউ কেউ প্রতিরোধে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। তাদের হাতে হাতে অস্ত্র। বেশিরভাগই প্রাণ বাঁচাতে দৌড়াচ্ছে দিগ্বিদিক। আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের কর্মীরা মারিউপোলের পরিস্থিতিকে ‘বেদনাদায়ক’ বলে বর্ণনা করেছেন। ছবি ও ভিডিওতে মারিউপোলের করুণ চিত্র দেখা গেছে। জীবন নিয়ে পালাচ্ছে মানুষ। তাদের এক হাতে ব্যাগ, এক হাতে শিশু-কোলে ও কাঁধে।
শিশুর মলিন চোখে ক্যামেরার চোখ পড়লেই ফুটে উঠছে জিজ্ঞাসা-কেন এই যুদ্ধ? তবু যুদ্ধ চলছে। রাশিয়ার পরাক্রমী বাহিনীর বিরুদ্ধে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের প্রাণকেন্দ্রে প্রতিরোধ দুর্গ গড়ে তুলেছে দেশটির যোদ্ধারা। তবে রাজধানীর আশপাশে ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ধসে গেছে সেতু। সেখানে দেখা গেছে, হাতে হাত ধরে মানুষ অগভীর নদী পার হচ্ছে দলে দলে-শিশু ও বৃদ্ধও আছে। অন্তঃসত্ত্বা নারী রয়েছে। অসুস্থ মা আছে। সেই দলে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত শরীরে টলে পড়া কিশোর ও কিশোরীও রয়েছে। উদ্ধারকারীদের হাতে ও কোলে দেখা গেছে আহত শিশু। যুদ্ধের বিভীষিকায় পদে পদে পরাস্ত হচ্ছে মানবতা।
রোববার ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ১১তম দিন ছিল। যুদ্ধের বর্বরতা আর বারুদের গন্ধ চারদিকে। ইউক্রেনের দাবি, যুদ্ধ শুরুর পর অন্তত ১০ হাজার রুশ সেনা নিহত হয়েছেন। তাছাড়া ২৬৯টি ট্যাংক, ৪০টি হেলিকপ্টার, ৫০টি এমএলআরএসসহ রাশিয়ার বহু অস্ত্র ও সরঞ্জাম তারা গুঁড়িয়ে দিয়েছেন। ইউক্রেনের মারিউপোল ও ভলোনোভাখায় টলমল যুদ্ধবিরতির মধ্যে চলেছে রুদ্ধশ্বাস উদ্ধার তৎপরতা। তাতে পদে পদে বাধা আর মৃত্যুঝুঁকি। মরছেও অনেকে। মারিউপোল ইউক্রেনের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরনগরী। শহরটিতে কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধবিরতি ছিল। বেসামরিক মানুষকে সরে যাওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে ‘মানবিক পথ’। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেছে ইউক্রেন। পাল্টা অভিযোগে মস্কো বলেছে, উগ্র জাতীয়তাবাদীরা সাধারণ মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য আটকে রেখেছে। এরপর মারিউপোল শহরে নতুন করে সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়েছে। মারিউপোলের সিটি কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
মারিউপোলের সিটি কাউন্সিলের বরাত দিয়ে খবরে বলা হয়, স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি কার্যকর থাকবে। বেসামরিক বাসিন্দারা এই সময় শহর ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। মারিউপোলের শহর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যারা ব্যক্তিগত গাড়িতে যাবেন, তারা যেন রেডক্রসের বাসের পেছনে পেছনে থাকেন। এছাড়া গণপরিবহণে গাড়ির সক্ষমতার সবটুকু ব্যবহার করে যাত্রী নেওয়ার অনুরোধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদল সোমবার তৃতীয় দফায় বৈঠকে বসতে যাচ্ছে। ইউক্রেনে রক্তাক্ত সংঘর্ষ অবসানের লক্ষ্যে এর আগে বেলারুশে উভয়পক্ষ আরো দুদুফা বৈঠক করেছে। ইউক্রেনের আলোচক ডেভিড আরাখামিয়া বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কির দলের পার্লামেন্টারি নেতা এবং প্রতিনিধি দলের সদস্য আরাখামিয়া তার ফেজবুক পেজে বলেন, আজ সোমবার তৃতীয় দফার বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এর আগে বেলারুশের গোমেল অঞ্চলে ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন বেলারুশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভ্লাদিমির মাকেই। তবে দেশ দুটির মধ্যে প্রথম বৈঠকটি হয় ইউক্রেন-বেলারুশ সীমান্তে। সেসময় কোনও ধরনের চুক্তি ছাড়াই ওই বৈঠক শেষ হয়।
এদিকে, ইউক্রেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দাবি, গত শনিবার দুটি রুশ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামিয়ে দুই পাইলটকে বন্দি করা হয়েছে। এ সময় যুদ্ধবিমান নামাতে গিয়ে মৃত্যু হয়েছে এক সহকারী পাইলটের। নেটমাধ্যমে সেই ভিডিও প্রকাশ করেছে ইউক্রেন। খবর ফ্রি প্রেস জার্নালের। দুটি ঘটনাই শনিবারে ঘটেছে বলে দাবি ইউক্রেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ইউক্রেন সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সরকারি টুইটার হ্যান্ডল থেকে একটি রুশ যুদ্ধবিমানকে গুলি করে নামানোর ভিডিও শেয়ার করা হয়েছে। এতে দাবি করা হয়েছে, ভিডিওটি উত্তর ইউক্রেনের চেরনিহিভের। সেই যুদ্ধবিমানের পাইলটকে বন্দি করা হয়েছে। পাশাপাশি মৃত সহকারী পাইলটের নামও জানিয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের দাবি, তাদের সেনাদের গুলিতে নিকোলেইভে আরও একটি রুশ যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়েছে। এটি পাইলটকেও বন্দি করেছে তারা।
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর জানিয়েছে, যুদ্ধ শুরুর পর থেকে শুক্রবার পর্যন্ত ৩৫১ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া সেনাসহ নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৫৮। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা জানিয়েছে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইউক্রেনীয় শরণার্থীর সংখ্যা ১৩ লাখ ছাড়িয়েছে। পথে রয়েছে আশ্রয়ের খোঁজে থাকা কয়েক লাখ মানুষ। এদিকে কিয়েভে স্কাই নিউজের একজন রিপোর্টারও একজন ফটো সাংবাদিক গুলিবিদ্ধ হয়েছেন বলে জানা গেছে।
অপরদকে, ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দখল করে নেওয়ার পর রোববার কেন্দ্রটি ঘিরে হাজার হাজার ইউক্রেনীয় জড়ো হয়। সেখানে তারা এই বিদ্যুৎকেন্দ্র দখলমুক্ত করতে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যোগ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এ দিন কৃষ্ণসাগরের পাড়ের বন্দর-শহর খেরসনেও তুমুল প্রতিবাদ করেছে ইউক্রেনীয়রা। খেরসন রুশ বাহিনীর দখলে রয়েছে। এটি মুক্ত করার শপথ নিয়েছে তারা। দুটি শহরেই সোমবার পাল্টাপাল্টি হামলা হয়েছে। খেরসন, মারিউপোল এবং ওডেসা সমুদ্রবন্দরকেন্দ্রিক নগরী। এগুলোতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে রুশ বাহিনী। ইউক্রেন এখন প্রায় সমুদ্রপথ থেকে বিচ্ছিন্ন। ফলে যুদ্ধের ধ্বংসলীলার মধ্যে খাদ্য ও খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। তা যদি হয়, তাহলে গোলাগুলির আঘাতের চেয়ে ক্ষুধার যন্ত্রণা বেশি মর্মান্তিক হয়ে উঠবে।
সূত্র জানায়, রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের সুমাই অঞ্চল ও দক্ষিণপূর্বাঞ্চলীয় বন্দরনগরী মারিওপোল ‘মানবিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে’ বলে মন্তব্য করেছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি সরকারের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা। সুমাই অঞ্চলের উত্তরের আখতিরকা ও ত্রস্তিয়ানেতস শহরে এখন বিদ্যুৎ ও পানি নেই, বলেছেন ইউক্রেইন সরকারের উপদেষ্টা ভাদিম দেনিসেনকো। রুশ হামলা অব্যাহত থাকলেও গত শনিবার রাত ‘তুলনামূলক শান্ত’ ছিল বলেও তিনি জানান, মারিওপোল থেকে বেসামরিকদের বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে গত শনিবার রাশিয়া ও ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দিলেও তা ৩০ মিনিটও স্থায়ী হয়নি। এরপর ফের রুশ বাহিনীর গোলাবর্ষণ শুরু হয়। গতকাল রোববার ওই ‘মানবিক করিডোর’ ফের খুলে দেওয়া হতে পারে বলে রুশপন্থি বিদ্রোহীদের পরিচালিত দোনেৎস্কের কর্মকর্তা এডুয়ার্ড বাসুরিনের বরাত দিয়ে জানিয়েছে রাশিয়ার বার্তা সংস্থা ইন্টারফ্যাক্স।
