



রুশ সেনাদের অগ্রযাত্রা ধীর হয়ে যাওয়ার দাবি ইউক্রেনের॥ অভিযান বন্ধে যে যে শর্ত দিল রাশিয়া॥ ইউক্রেনকে ৭২৩ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক
#হাবিবুর রহমান, ঢাকা: রাশিয়ার সঙ্গে মানবিক করিডোর চালু করার চুক্তিতে পৌঁছানোর পর প্রথমবারের মতো স্থানীয় বাসিন্দা এবং বিদেশি শিক্ষার্থীদের একটি দল ইউক্রেনের সুমি শহর ছেড়েছে। করিডোর চালুর সিদ্ধান্ত রুশ সৈন্যদের অনবরত গোলাবর্ষণের মুখে ভেস্তে যাওয়ার পর নতুন চুক্তি অনুযায়ী, গতকাল মঙ্গলবার লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে বলে রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয় জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চেরিহিভ, সুমি, খারকিভ, মারিউপোল এবং রাজধানী কিয়েভ থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য মানবিক করিডোর চালু করা হয়েছে। সুমি ছাড়াও রাজধানী কিয়েভের পশ্চিমের শহর ইরপিন থেকেও একদল বাসিন্দাকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এই অঞ্চলের প্রধান ওলেক্সি কুলেবা বলেছেন, রোমানভিকা গ্রামের ভেতর দিয়ে শহরের জনসংখ্যাকে কিয়েভ শহরে সরিয়ে নেওয়ার কাজ অব্যাহত রয়েছে। স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টা পর্যন্ত সেখানকার ১৫০ জনের বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। এর আগে, বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে রুশ সৈন্যদের গোলাবর্ষণের কারণে এ ধরনের করিডোর প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা ভেস্তে যায়। রাশিয়ার সংবাদসংস্থা ইন্টারফ্যাক্স বলছে, মঙ্গলবার ইউক্রেনের স্থানীয় সময় সকাল ৯টা থেকে গোলাবর্ষণ বন্ধ রেখেছে রুশ সামরিক বাহিনী।
এক টুইটে ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয় বলেছে, আমরা ইতোমধ্যে সুমি থেকে বিদেশী শিক্ষার্থীসহ বেসামরিক নাগরিকদের পোলটাভা (মধ্য-ইউক্রেনে) শহরে সরিয়ে নেওয়া শুরু করেছি। ইউক্রেনে অন্যান্য মানবিক করিডোর চালুর বিষয়ে আমরা ঐকমত্যে পৌঁছানোর জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন শুরু হওয়ার পর বেসামরিক লোকজন লড়াইয়ের মাঝে আটকা পড়েছেন। ইউক্রেনকে ‘নাৎসিমুক্ত এবং অসামরিকায়ন’ করার লক্ষ্যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন প্রতিবেশী এই দেশটিতে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ। তারপর থেকে রুশ সৈন্যদের গোলাবর্ষণ, ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইউক্রেনের বিভিন্ন শহর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। গত সোমবার ইউক্রেনের কয়েকটি শহর থেকে বেসামরিক লোকজনকে বেলারুশ এবং রাশিয়ায় সরিয়ে নিতে মানবিক করিডোর চালুর প্রস্তাব দেয় মস্কো। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজ দেশের নাগরিকদের অন্য দেশে চলে যেতে রাশিয়ার মানবিক করিডোর চালুর প্রস্তাবকে অনৈতিক আখ্যায়িত করে তা প্রত্যাখ্যান করেন।
অপরদিকে ইউক্রেনের একটি বেকারিতে রাশিয়ার সামরিক বাহিনীর চালানো হামলায় কমপক্ষে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির রাজধানী কিয়েভ থেকে ৫০ কিলোমিটার (৩১ মাইল) পশ্চিমে অবস্থিত মাকারিভ শহরের একটি শিল্প বেকারিতে চালানো হামলায় প্রাণহানির এই ঘটনা ঘটে। ইউক্রেনীয় কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে গত সোমবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা। এদিকে, যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ হাউস অব কমন্সে মঙ্গলবার বিকেল ৫টার দিকে ভাষণ দেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরা ও ইউক্রেনের পক্ষে জনমত গড়ার অংশ হিসেবেই এই ভাষণ দেন তিনি। এক প্রতিবেদনে বার্তাসংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ব্রিটেনের আইন প্রণেতাদের উদ্দেশে মঙ্গলবার বিকেল ৫ টার দিকে ভার্চুয়াল মাধ্যমে ভাষণ দেন জেলেনস্কি। বক্তব্য প্রদানের জন্য এই সময় বেছে নেওয়ার কারণ নিয়ম অনুযায়ী, হাউস অব কমন্সের নিয়মিত পার্লামেন্টারি কাজের সময় শেষ হয় বিকেল ৫ টার পর। যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট ভবনের নাম ওয়েস্ট মিনিস্টার হল এবং পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষের নাম হাউস অব লর্ডস। তবে দেশটির জাতীয় রাজনীতিতে নিম্নকক্ষেরই প্রভাব বেশি। আগে ৪ জন বিদেশি শীর্ষনেতা হাউস অব কমন্সের আইন প্রণেতাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দিয়েছেন। তারা হলেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান, বিল ক্লিনটন, বারাক ওবামা ও জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যানজেলা মের্কেল। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যার দিকে জেলেনস্কি হয়েছেন এই তালিকার ৫ম ব্যক্তি।
সূত্র জানায়, রুশ অভিযানের সবশেষ চিত্র তুলে ধরেছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। তাদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শত্রুরা আক্রমণাত্মক অভিযান অব্যাহত রেখেছে তবে তাদের বাহিনীর অগ্রযাত্রার গতি উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর হয়ে পড়েছে। রুশ অভিযানের ১৩তম দিনে স্থানীয় সময় গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টার দিকে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ বিবৃতিতে জানান, ইউক্রেনীয় বাহিনী দক্ষিণাঞ্চল, পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চল সেক্টর সুরক্ষা অব্যাহত রেখেছে। রাজধানী কিয়েভ এবং উত্তরাঞ্চলীয় শহর চেরনিহিভ এখনও তাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ওই বিবৃতিতে আরো দাবি করা হয় ইউক্রেনের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সফলতার সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলা প্রতিহত করছে। বিবৃতিতে বলা হয়, দখলদারদের মনোবল ভেঙে গেছে আর তাদের লুটপাট এবং সামরিক সংঘাত নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন ভঙ্গের পরিমাণ বেড়েছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী আরো দাবি করেছে রাশিয়া এখন মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ শুরু করেছে। দখলকৃত এলাকার স্থানীয় বাসিন্দাদের ওপর প্রভাব বিস্তারে প্রপাগান্ডা কার্যক্রম চালাতে রুশ বাহিনী বিশেষ গ্রুপ গঠন করেছে বলেও দাবি করেছে ইউক্রেনীয় বাহিনী। তবে এসব দাবি নিরপেক্ষভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি।
অপরদিকে, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের কার্যালয় ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, চলমান যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনকে কিছু শর্ত বেঁধে দিয়েছে রাশিয়া। কিয়েভ যদি এ শর্তগুলো পূরণ করতে পারে, তবে মুহূর্তের মধ্যেই সামরিক অভিযান বন্ধ করে দেবে রাশিয়া। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে পেসকভ আরো বলেছেন, ইতিমধ্যে এ শর্তগুলোর ব্যাপারে ইউক্রেনকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। চলমান সংঘাত বন্ধে ইতিমধ্যে বেলারুশ সীমান্তে তিন দফা বৈঠক করেছে রাশিয়া ও ইউক্রেন। গত সোমবার গোমেল শহরে তৃতীয় দফার বৈঠক শেষে ইউক্রেনের প্রতিনিধিদলের সদস্য ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা মিখাইলো পোদোলিয়াক এক ভিডিও বার্তায় বলেন, আলোচনায় বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে সামান্য অগ্রগতি হয়েছে। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে উল্লেখযোগ্য কিছু হয়নি। যুদ্ধবিরতি নিয়ে দুই পক্ষের আলোচনা চলবে।
অন্যদিকে, রাশিয়ার প্রতিনিধিদলের সদস্য ভ্লাদিমির মেদিনস্কি বলেছেন, এ বৈঠক থেকে ইতিবাচক কিছু আসবে কি না, তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। তৃতীয় দফার এ বৈঠকের প্রস্তুতি চলার সময় রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেন ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। তিনি বলেন, চলমান অভিযান বন্ধে কিয়েভকে কিছু শর্ত দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো ইউক্রেনকে সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করতে হবে, নিরপেক্ষতা নিশ্চিতের লক্ষ্যে সংবিধানে পরিবর্তন আনতে হবে, ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার ভূখণ্ডের অংশ বলে স্বীকার করতে হবে এবং দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলকে স্বাধীন ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযান শুরুর পর যুদ্ধ বন্ধের প্রশ্নে এটিকে ক্রেমলিনের সবচেয়ে স্পষ্ট বক্তব্য বলে মনে করা হচ্ছে। নিরপেক্ষতার প্রশ্নে দিমিত্রি পেসকভ বলেছিলেন, তাদের উচিত সংবিধানে সংশোধনী নিয়ে আসা, যার মধ্য দিয়ে ইউক্রেন বোঝাবে যে তারা কোনো জোটে যোগ দেবে না। সংবিধানে পরিবর্তন আনার মধ্য দিয়েই তা কেবল সম্ভব হবে।
ক্রেমলিনের মুখপাত্র দাবি করেছেন, ইউক্রেনে আর কোনো এলাকার মালিকানা দাবি করতে চায় না রাশিয়া। তিনি বলেন, আমরা সত্যিকার অর্থে ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণের কাজ করছি। আমরা এ কাজ শেষ করব। তবে মুখ্য বিষয় হলো ইউক্রেনের সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করবে। তাদের উচিত সামরিক পদক্ষেপ বন্ধ করা। তাহলে কেউ আর গুলি চালাবে না। জানা গেছে, ইউক্রেন সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনা, বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদানে সহায়তা করতে দেশটির জন্য ৭২৩ মিলিয়ন বা ৭২ দশমিক ৩ কোটি ডলারের জরুরি তহবিল বরাদ্দ দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে ইউক্রেনে হামলা শুরু করে রাশিয়ান সৈন্যরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে ইউক্রেনে এই হামলা শুরু করে। একসঙ্গে তিন দিক দিয়ে হওয়া এই হামলায় ইউক্রেনের বিভিন্ন শহরে রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পড়েছে বৃষ্টির মতো। সর্বাত্মক হামলা শুরুর পর এক সপ্তাহের মধ্যেই পূর্ব ইউরোপের এই দেশটির বহু শহর কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। সামরিক অবকাঠামোর বাইরে রাশিয়ার হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে আবাসিক ভবন, স্কুল ও হাসপাতাল। ধ্বংস হয়ে গেছে সামরিক-বেসামরিক বহু অবকাঠামো। আর এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেন সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনা, বেতন-ভাতা ও পেনশন প্রদানে সহায়তা করতেই আর্থিক সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হলো।
বিশ্বব্যাংক জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, জাপান, ডেনমার্ক, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া এবং আইসল্যান্ড এই প্যাকেজে অর্থ যোগান দিচ্ছে। এছাড়া আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ইউক্রেন ও প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য ৩০০ কোটি ডলারের একটি তহবিল ছাড় করার ব্যাপারেও তারা কাজ করছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। এদিকে রাশিয়ার সর্বাত্মক হামলার মুখে ঘর-বাড়ি ছেড়ে প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে গেছেন ১৭ লাখেরও বেশি ইউক্রেনীয়। রুশ আক্রমণের কারণে শরণার্থীতে পরিণত হওয়া এসব মানুষের বেশিরভাগই নারী, শিশু ও বয়স্ক নাগরিক। ইউক্রেনের জন্য অর্থ বরাদ্দের পাশাপাশি শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্যও অতিরিক্ত সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড মালপাস এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, রাশিয়ার আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট সহিংসতা এবং চরম বিপর্যয়ের মুখে ইউক্রেন ও দেশটির জনগণকে সহায়তা করার জন্য বিশ্বব্যাংক গ্রুপ দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিশ্বব্যাংক বলছে, তাদের বরাদ্দকৃত এই তহবিল হাসপাতালের কর্মীদের বেতন, বয়স্কদের জন্য পেনশন এবং ঝুঁকিপূর্ণদের জন্য সামাজিক কর্মসূচিসহ গুরুত্বপূর্ণ পরিষেবা চালিয়ে নিতে ইউক্রেনের সরকারকে সহায়তা করবে।
