



#হাবিবুর রহমান, ঢাকা: ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা পরিচালনায় এ খাত-সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করাসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, ২০০৯ সালে খেলাপি ঋণ ছিলো ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। যা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস শেষে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ১৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকায়। প্রতিবছরে গড়ে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি ৯ হাজার ৩৮০ কোটি টাকা। গত ১০ বছরে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ার পরিমাণ ৪১৭ শতাংশ। মঙ্গলবার টিআইবির ‘ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন উপস্থাপনকালে আয়োজিত সাংবাদিক সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।
সাংবাদিক সম্মেলনে জানানো হয়, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ ব্যাংকের সুশাসনের চ্যালেঞ্জসমূহ পর্যালোচনা করে প্রাপ্ত ফলাফলের ভিত্তিতে সুপারিশ প্রণয়ন করা এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। গবেষণার জন্য ২০১০ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময় বিবেচনা করে ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকসমূহ নিয়ন্ত্রণ বিশেষত ঋণ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি ভূমিকা সুশাসনের বিভিন্ন সূচকের আলোকে পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিপুল পরিমাণের খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমের ক্ষেত্রে প্রধানত দুই ধরনের সুশাসনের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। একটি হলো বাহ্যিক প্রভাব- যার মধ্যে রয়েছে আইনি সীমাবদ্ধতা, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও ব্যবসায়িক প্রভাব এবং অপরটি হচ্ছে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ- যার মধ্যে রয়েছে তদারকি সক্ষমতায় ঘাটতি, নেতৃত্বের সক্ষমতায় ঘাটতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় ঘাটতি এবং তদারকি কাজে সংঘটিত অনিয়ম দুর্নীতি। গবেষণায় দেখা যায়, সরকারি নীতি ও কৌশলসমূহে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাত সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের অধিকতর সুশাসনের কথা বলা হলেও এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। একদিকে ব্যবসায়ীদের ইচ্ছায় সরকার কর্তৃক তাদের অনুকূলে আইন পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে ব্যবসায়ীদের অবাধ প্রবেশ ও নিয়ন্ত্রণের সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নানা আইনি বাধা, সদিচ্ছার ঘাটতি ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তার প্রাপ্ত ক্ষমতা চর্চায় ব্যর্থ হচ্ছে। এছাড়া তদারকির সক্ষমতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতি ও তদারকি কার্যক্রমে অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাংকিং খাতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের ক্রমশ অবনমন ঘটেছে এবং প্রতিষ্ঠানটি স্বার্থসংশ্লিষ্টদের আজ্ঞাবাহীতে পরিণত হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকিং খাতে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মাধ্যমে সমগ্র ব্যাংকিং খাতে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে এসব গোষ্ঠী বা পরিবার রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ হিসেবে নিজেদের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের দখলে নিয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণ অনুৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ ও বিদেশে অর্থ পাচার জাতীয় অর্থনীতির বিকাশে ব্যাংকিং খাতের কাক্সিক্ষত ভূমিকাকে ব্যাহত করছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হলেও তা কার্যকর না করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বারবার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ প্রদান করা হয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনায় খেলাপি ঋণের মাত্র দুই শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃতফসিলীকরণের মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ প্রদান করা হয়। এভাবে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর হতে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়। ঋণ খেলাপিদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ সুবিধা প্রদান ও খেলাপি ঋণ কম দেখাতে বিবিধ কৌশল অবলম্বন সত্ত্বেও জুনে খেলাপি ঋণের পরিমাণ পুনরায় বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। অথচ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহের খেলাপি ঋণের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি মেটাতে ২০১২-১৩ অর্থ বছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থ বছর পর্যন্ত সরকার কর্তৃক ১২ হাজার ৪৭২ কোটি ৮৭ লক্ষ টাকা ভর্তুকি প্রদান করা হয়। গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, বিশেষজ্ঞদের মতে প্রয়োজনীয়তা না থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় ২০০৯ সালের পর থেকে রাজনতৈকি প্রভাবের কারণে বাংলাদশে ব্যাংক ১৪টি নতুন ব্যাংকের অনুমোদন প্রদান করে। বিভিন্ন ব্যাংকের তদারকি কার্যক্রমেও রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়। অনেক সময়ই বাংলাদেশ ব্যাংক যে কোনো ব্যাংকের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে গেলে শীর্ষ পর্যায়ের বিভিন্ন মন্ত্রী/মন্ত্রণালয় থেকে টেলিফোনে চাপ প্রয়োগ করে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। ব্যাংক উদ্যোক্তাদের অধিকাংশ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের অংশ বা সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে আইন লঙ্ঘন করলেও অনেক ক্ষেত্রে তাদের ছাড় দেয়া হয়ে থাকে।
সাংবাদিক সম্মেলনে ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারায় উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্র মালিকানাধীন বা ব্যক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে জনগণের অর্থ ও আমানত নিয়েই ব্যবসা করে থাকে- এই বাস্তবতার স্বীকৃতি বাংলাদেশে ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের স্বেচ্ছাচারী প্রবণতায় মনে হয়, ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের অর্থ যেন কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ যা তাদের খুশিমত ব্যবহার করা যাবে। আবার ব্যাংক মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার- এই তিন পক্ষও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ যে জনগণের সম্পদ সেটি ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী তথা ঋণখেলাপিদেরকেই ক্রমাগতভাবে সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক সময় তারা ঋণখেলাপি, জালিয়াতিকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী ও অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। এমনকি সরকারকেও তাদের কাছে জিম্মি মনে হয়। তিনি বলেন, যে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা- তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণ খেলাপীদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।
গবেষণায় প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো- ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এখাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে, ব্যাংক কোম্পানী আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে, নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, ব্যাংক সংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সকল ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল গঠন করে সেখান থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে, রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সাথে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে, তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে ইত্যাদি।
