News Britant

এক চিলতে চিলেকোঠার পাশে

Listen

( খবর টি শোনার জন্য ক্লিক করুন )

#দেবলীনা ব্যানার্জী: সে ছিল এক স্বপ্নের দিন, চিলেকোঠায় রূপ নিত জীবনের প্রথম স্বাধীনতা। স্কুল জীবনে বড়দের শাসন এড়িয়ে এক দৌড়ে লুকিয়ে পড়া ছোট্ট চিলেকোঠার ঘরে। শিশু কিশোরের গুপ্তধনের খনি এই চিলেকোঠার ঘর। বাড়ির বাতিল হওয়া জিনিসপত্রের ঠাঁই হত ছাদের ওপরের যে একচিলতে ঘরে, সে ঘরে শিশুমন খোঁজ পেত অমূল্য মণি মাণিক্যের। বাতিল হওয়া প্লাস্টিকের ভাঙা পিস্তল হাতে অবুঝ মানুষটি হয়ে উঠত অবলীলায় ক্যাপ্টেন স্পার্ক।

কল্পনার ডানায় ভর করে অনায়াসে পাড়ি দেওয়া যেত অচিনপুরে। কখনও অলস দুপুরে মা দিদিমার হালকা ঘুমের সুযোগে পা টিপে টিপে আচার চুরি, আশ্রয়স্থল সেই চিলেকোঠার ঘর। অথবা পাঠ্যবইয়ের কচকচানি থেকে ছুটি নিয়ে রহস্য রোমাঞ্চ গল্পের বইটি হাতে সোজা চিলেকোঠা। নাওয়া খাওয়া ভুলে বইয়ের পাতায় ডুবে যাওয়া কৈশোর। চিলেকোঠার পাশে জীবন্ত সাক্ষাৎ সেইসব রহস্য রোমাঞ্চের নায়ক বা খলনায়কদের সাথে। বাস্তবিকই চিলেকোঠার পাশে এখনো পড়ে আছে বর্তমান অতিব্যস্ত যুবক বা স্মৃতিমেদুর প্রৌঢ়ের রঙিন কৈশোর।  যার স্মৃতিচারণ আজও একমুঠো তাজা হাসি এনে দেয় ব্যস্ত জীবনে। বড়দের শাসন এড়িয়ে চিলেকোঠার ঘর ঘিরে এই যে জগৎ তা বাঙালি জীবনে বাস্তবিকই নস্ট্যালজিয়া।

গল্প, কবিতা,  গান, আড্ডা ঘিরে তাই চিলেকোঠা বারবার উঠে আসে বাঙালিমননে। এ সম্পদ বাঙালির একান্তই নিজস্ব। তবে বর্তমান প্রজন্ম কি ঠিক এতটাই পরিচিত এই চিলেকোঠার সাথে! হয়ত বা নয়। চিলেকোঠাকে ঘিরে যাবতীয় স্মৃতিমেদুরতা তাই দুই দশক আগের প্রজন্মে এসে থমকে গেছে। ইঁট কাঠ পাথরের শহুরে ফ্ল্যাটকালচার এসে ধ্বংস করেছে চিলেকোঠাকে। একান্নবর্তী পরিবারের সেই বাড়িটি ভাগ হয়েছে অনেক ভাগে, উঠে গেছে পাড়াকালচার, মেশিনসর্বস্ব জীবন গ্রাস করেছে চিলেকোঠার আস্বাদ। নতুন প্রজন্ম মুখ ঢেকেছে কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইলে।

কল্পনার আশ্রয় আর নিতে হয়না শিশুমনকে, রঙিন পর্দায় ভেসে ওঠে কল্পনার ছবি আগেভাগেই।  চিন্তা চেতনার অবলুপ্তির প্রজন্মে ঠিক এই সময়ই খুব প্রয়োজন এক চিলতে চিলেকোঠার।  ব্যস্ত জীবনে একটু ছুটি নিয়ে চিলেকোঠার ঘরের নিখাদ আনন্দকে  আস্বাদ করার সুযোগ দেওয়া হোক বর্তমান প্রজন্মকে। ঠিক এই চিন্তাভাবনা মাথায় নিয়েই কিছু সংস্কৃতিপ্রেমী যুবক যুবতী আজও চেষ্টা করে চলেছে বাঙালির হারানো সংস্কৃতিকে ফিরিয়ে আনার। রায়গঞ্জের বিদ্রোহী মোড় সংলগ্ন একটি মুক্ত পরিবেশে গাছপালা ও প্রকৃতির সান্নিধ্যে মঞ্চ প্রস্তুত করে অনুষ্ঠিত হল ‘চিলেকোঠার পাশে’।

ইঁদুরদৌড়ের জীবন থেকে একটু সময় বের করে গানে  গল্পে বাঁশির সুরে মেতে উঠলেন সকলে। সুরের মূর্ছনায় যোগ দিয়েছিল শহরের তরুণ গায়ক গায়িকারা। আডা গল্প গানের পাশাপাশি নৈশভোজের ব্যবস্থা ছিল। এ বছর ‘চিলেকোঠার পাশে’ চতুর্থ বর্ষে পা রেখেছে। করোনার কারণেও কোনো বছরই বন্ধ হয়নি এই অনুষ্ঠান। কারণ হিসেবে উদ্যোক্তারা জানান, প্রতি বছরই এই সময়টাতে করোনার প্রকোপ কম ছিল। তাছাড়া মুক্ত পরিবেশে গান শুনতে বাধা হয়ে দাঁড়ায় নি কোভিডবিধি। প্রথম বর্ষ থেকেই এই অনুষ্ঠানের প্রধান উদ্যোক্তা হিসেবে রয়েছেন সোমক মুখার্জি ও সুদীপ্ত সান্যাল।

‘চিলেকোঠার পাশে’ র মত একটা অনুষ্ঠানের চিন্তাভাবনার কারণ কি সেই প্রসঙ্গে সোমক জানালেন, “চন্দ্রবিন্দু ব্যান্ড ‘আমাদের ছাদে’ বলে একটা অনুষ্ঠান করত, সেখান থেকেই চিলেকোঠার পাশের চিন্তা মাথায় আসে আসে। এই অনুষ্ঠান শুরু করার পেছনে মুখ্য উদ্দেশ্য যেটা ছিল, আমাদের শহরে অনেক ছেলেমেয়েরা গানবাজনার সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু তারা সকলকে শোনানোর মত মঞ্চ পায়না। এই সমস্ত শিল্পীদের মঞ্চ দেওয়ার তাগিদ থেকেই অনুষ্ঠানটা শুরু করি। এখানে যেমন শহরের নামকরা শিল্পীরা গান গাইছেন,  তেমনই এমন অনেক শিল্পীও আছেন যারা প্রথম মঞ্চে গাইছেন। শ্রোতাদের উৎসাহ ও প্রশংসা তাদের আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, শিল্পীরা যখন মঞ্চে বা কোনো কনসার্টে গান করেন, অনেক সময়ই তাদের ফরমায়েশি গান করতে হয়। সেই গান হয়ত তালের গান বা বাজারচলতি নাচের গান।

কিন্তু চিলেকোঠার পাশে এমন একটা মঞ্চ যেখানে শিল্পীরা নিজের পছন্দের গান করেন। কোনো ফরমায়েশি গান এখানে হয় না। শিল্পীদের মনের খোরাক জোগানোর মঞ্চ চিলেকোঠা। “এছাড়াও সোমক জানান, নামের সঙ্গে সাজুয্য রেখে চিলেকোঠা প্রথম দু বছর বাড়ির ছাদেই করা হয়েছে। কিন্তু এখন সদস্যসংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে ছাদে কুলোনো যাচ্ছে না এই আড্ডার পরিসর। সেই কারনেই চিলেকোঠাকে নিয়ে আসা হয়েছে বৃহত্তর পরিসরে।

News Britant
Author: News Britant

Leave a Comment