



#হাবিবুর রহমান, ঢাকা: সম্প্রতিকালে মায়ানমারের অভ্যন্তরে উগ্র রোহিঙ্গা সলভেশন আর্মির সঙ্গে দেশটির সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের কারণে আবারও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছেন রোহিঙ্গারা। ইদানীং সীমান্তে গোলাগুলির শব্দ শোনা যাচ্ছে অহরহ। কয়েকদফা মায়ানমারের গোলাও এসে পড়েছে বাংলাদেশ সীমান্তে।ঢাকায় বিদেশমন্ত্রকে মায়ানমার রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদও জানানো হয়েছে।গত দুইদিনে ১৫জন রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। স্থানীয় সূত্র জানায়-মায়ানমারের ওপারে বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন আরও হাজারো রোহিঙ্গা। বান্দরবানের নাইক্ষ্যং ছড়ির ঘুমধুম, তুমব্রু, উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে প্রবেশের অপেক্ষায় আছেন তাঁরা।
কুতুপালং-এর স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য হেলালউদ্দিন জানান, সম্প্রতি ৩০জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশ প্রবেশ করে বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা বিষয়টি সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। বেশ কিছু রোহিঙ্গা নতুন করে বাংলাদেশে আসারও চেষ্টা করছেন। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো হত্যা, অগ্নিসংযোগ লুটপাট থেকে বাঁচতে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় সাড়ে ৭ লাখ রোহিঙ্গা। এর আগে থেকে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া চার লাখ রোহিঙ্গাসহ মোট শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১২ লাখের বেশি।এ কয়বছরে এক লাখ রোহিঙ্গা জন্ম নিয়েছে।
এতে করে উখিয়ার কুতুপালং পরিণত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে সই করে মায়ানমারের অং সান সু চি সরকার। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে যায়। গেল এক বছরে রোহিঙ্গা ইস্যূতে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গণমাধ্যমের শিরোনাম জুড়ে ছিল কক্সবাজার ও ভাসানচর থেকে এই শরণার্থীদের পালানোর চেষ্টা, কক্সবাজারের ক্যাম্পে আগুন এবং ক্যাম্পকেন্দ্রিক বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড। প্রায় ১ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার কার্যক্রম বাংলাদেশ সরকার হাতে নেয়।
প্রথমদিকে বিদেশি দাতাসংস্থার চরম বিরোধীতার অবশেষে তাতে যুক্ত হতে যাচ্ছে রাষ্ট্রসংঘ। ভাসানচর সেখান থেকে চলতি মাসে পালানোর চেষ্টাকালে সলিল সমাধি হয়েছে অনেক রোহিঙ্গার। এছাড়া সেখান থেকে গত এক বছরে পালানোর চেষ্টা করে আটক হয়েছে কয়েকশ জন।২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ঢলের কারণে শুধু এই সংকট তৈরি হয়নি, এই সংকট কয়েক দশকের পুরনো। মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল শুরু হয়, তাতে মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ কক্সবাজারে চলে আসে। যুগ যুগ ধরে আশ্রয় দেয়া বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়। বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশের জোরালো প্রশংসা করলেও এই ইস্যূতে বাংলাদেশকে প্রত্যাশার চাপে রেখেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য পশ্চিমা দেশসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলো মানবিক সহায়তা পাঠালেও গেল পাঁচ বছরে সংকট সমাধান করতে এগিয়ে আসেনি।
এদিকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কিছুলোক ভয়ংকর হয়ে উঠেছে। যার কারণে স্থানীয়রা হুমকির মুখে পড়েছেন। তারা কথায় কথায় স্থানীয়দের ওপর হামলা করছে। বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় তথ্য মতে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২০টির বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। পুরো এলাকাজুড়ে মাদকের ডিপো আর খুন-খারাবি করছে। অপহরণ করে রোহিঙ্গাদের মুক্তিপণ আদায় এখন নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়িতে চুরি-ডাকাতি করছে। শুধু রোহিঙ্গা প্রবণ সীমান্ত এলাকা উখিয়া ও টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহর থেকে শুরু করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কায়দায় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে জায়গা-জমি জবর দখল করছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির নেতা অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত জানান, সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে এখন রীতিমতো ঝুঁকির মুখে বসবাস করছে। শিবিরগুলো এখন স্থানীয় লোকজনের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে।ক্যাম্পে কর্মরত কর্মকর্তারা জানিয়েছে, কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে বছরে ৩০ হাজার ৪০০ শিশু জন্মগ্রহণ করছে। সে হিসেবে গেল পাঁচ বছরে প্রায় দুই লাখ শিশু রোহিঙ্গা শিবিরে জন্মগ্রহণ করেছে। যদি রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসন করা না যায়, তাহলে বাংলাদেশ তথা পর্যটন নগরী কক্সবাজার মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে।মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে বাংলাদেশ অভিমুখে রোহিঙ্গাদের সেই যাত্রার পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে সম্প্রতি।
