



#কৌশিক চট্টোপাধ্যায়: বর্ষার কালো চাদর সরিয়ে একটু একটু করে পেঁজা তুলো মেঘে ভরে উঠছে শরতের আকাশ। গ্রাম বাংলার বর্ষার জলছবির অস্পষ্টতাকে কাটিয়ে সুরেলা ভোর হচ্ছে বৈশ্য পাড়ায়। পূজো শুরুর মাস খানেক আগে থেকে প্রতিদিনই ঢাকের আওয়াজে এভাবেই ঘুম ভাঙে শরত কালের সূর্যের। উত্তর দিনাজপুর জেলার মানুষের কাছে কালিয়াগঞ্জের এই প্রত্যন্ত গ্রাম্য পাড়াটি ঢাকি পাড়া নামেই পরিচিত। মহালয়ার অনেক আগে থেকেই এপাড়াগাঁয়ে শুরু হয়ে যায় মা দূর্গার আবাহনের প্রস্তুতি।
সারা বছরের জরাজীর্ণতাকে সরিয়ে নতুন উদ্যমে মেতে ওঠে পুরো গ্রাম। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের মানুষের প্রধান জীবিকা ঢাক বাজানো। আর তাই পিতৃপুরুষের হাতে ধরে শেখানো এই ঢাকের বোলকে স্বযত্নে ও স্বগর্বে উপার্যনের হাতিয়ার করে গড়ে তুলেছেন এ গ্রামের প্রতিটি পুরুষ। ছেলেবেলা থেকেই বিশু, ছোটন, গোবিন্দরা কাক ভোর থেকে শুনে আসছেন বাবা -কাকা দের পূজো প্রস্তুতির ঢাকের রেওয়াজ। সে সময়ের নিত্য নতুন ঢাকের বোল গ্রাম্য সকালকে করে তুলতো অদ্ভুত মোহময়ী। কিন্তু পূজো যতই এগিয়ে আসতো ততই বিশাদে ভরে উঠতো ছোট্ট শিশু মনগুলি।
শিউলি ভেজা ভোরে বাবা- কাকারা যখন ঢাক কাঁধে নিয়ে পারি দিত অনেক দূরের পথে। একলা মেঠো পথের দিকে চেয়ে একেবারে ফাঁকা হয়ে আসতো ছোট্ট শিশুদের মনগুলি। কিন্তু পেট যে বড় বালাই। ঢাকের তালে শহুরে বাবুদের মন ভরলেও, ভগবানের একটুও দৃষ্টি পরতোনা ঢাকিদের শূন্য ভাড়ারের দিকে। প্রজন্ম যায় প্রজন্ম আসে ঢাকি পাড়ার হতাশার অন্ধকারেই এভাবেই বেড়ে ওঠে ছোট্ট বিশু, ছোটন, গোবিন্দরা। স্বেচ্ছায় কাঁধে তুলে নেয় পিতৃ পুরুষের ব্যাটন। সেদিনের ছোট্ট বিশু কালক্রমে হয়ে ওঠে আজকের বিশু ঢাকি।
আমাদের মুখোমুখি হতেই একরাশ হতাশায় ভিজে গেল বিশু ঢাকির দুচোখ। তিনি জানালেন, এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি পরিবারের পুরুষেরা বংশ পরম্পরায় ঢাক বাজানোর কাজের সাথে যুক্ত। তাই পেটের টানে পরিবার ছেরে, বাড়ি ছেরে অনেক দুরের পূজো মণ্ডপেই কাটাতে হয় তাদের। তাই আর পাঁচটা বাঙালির মতো শারদোৎসবের উষ্ণতা ছুঁতে পারেনা এ গ্রামের একটিও পরিবারকে। তাছারা পূজোর চারটে দিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেও মেলেনা উপযুক্ত পারিশ্রমিক। সময় পরিবর্তন হয়েছে, পূজো উদ্যোক্তাদের কাছে সাবেকি বোল এর পরিবর্তে সমকালীন বাংলা অথবা হিন্দি গানের কদর অনেক বেশী।বাড়তি কিছু বকশিসের আশায় এই চারদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উৎসবের ঢাকে নানারকম বোল তুলে যায় তারা।
বিশু, ছোটন, গোবিন্দ ঢাকির স্ত্রী এবং পুত্ররা জানালেন, পূজোর এই কয়েকটি দিন ঢাকি পাড়ার নিস্তব্ধতা যেন কুঁড়ে কুঁড়ে খায় তাদের। তাই সেভাবে ঠাকুর দেখতে যাওয়া হয়না। শুধু প্রতীক্ষা করে থাকে পূজো শেষে দিন গুলির জন্য। যখন কাশবনের মধ্যদিয়ে মেঠো পথে ধীরেধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠবে বিশু, ছোটন, গোবিন্দদের আবছা শরীর। আর ঢাকি পাড়ার নিস্তব্ধতাকে খান খান করে বাতাসে ভাসবে বিশু ঢাকিদের ঘরে ফেরার ঢাকের আওয়াজ।
