



উপকূলের ১৯ জেলায় আঘাত হানবে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং॥ ৫ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের শঙ্কা॥ বন্দরে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত জারি॥ সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ ঘোষণা
#হাবিবুর রহমান, ঢাকা: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি রোববার রাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে রূপ নিয়ে শক্তি বাড়াচ্ছে। সাগরে দমকা ও ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ বেড়েছে। আরো শক্তি বাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং মঙ্গলবার সন্ধ্যায় উপকূলের ১৯ জেলায় আঘাত হানবে। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হতে পারে। সাগর উত্তাল থাকায় কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই বঙ্গোপসাগরে অবস্থান করা মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারগুলোকে শিগগির নিরাপদে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট নিম্নচাপটি রোববার রাতে ঘূর্নিঝড় সিত্রাংয়ে পরিণত হয়েছে। এটি আরও ঘনীভূত হয়ে শক্তি বাড়িয়ে সোমবার উত্তর উত্তর-পশ্চিম দিক বরাবর অগ্রসর হবে। মঙ্গলবার ভোরের দিকে তিনকোনা দ্বীপ ও সন্দ্বীপের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করবে এ ঘূর্ণিঝড়। এর প্রভাবে আজ সোমবার থেকেই দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় হালকা থেকে মাঝারি বৃষ্টি শুরু হবে। সোমবার দুই ২৪ পরগনায় ভারী থেকে অতিভারী বৃষ্টির সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এর ফলে ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে। চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দর এবং কক্সবাজারে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। এজন্য আতঙ্ক নিয়ে প্রহর গুনছে উপকূলবাসী।
আরো জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে সাগরে দমকা ও ঝোড়ো হাওয়ার গতিবেগ বেড়ে গেছে। খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার অঞ্চল সমূহের ওপর দিয়ে পূর্ব/উত্তর-পূর্বদিক থেকে অস্থায়ীভাবে দমকা/ ঝড়ো হাওয়াসহ থেমে থেমে বৃষ্টি হচ্ছে। বৈরী আবহাওয়ায় আতঙ্কিত উপকূলে বসবাসরত লাখ লাখ মানুষ। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাত হানার আশঙ্কায় উপকূলের মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। দুর্বল বাড়িঘরের বাসিন্দাদের পরিস্থিতি অনুযায়ী উঁচু পাকা ভবনে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও সিত্রাং মোকাবিলায় আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়েছে সরকার। ১০৩টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত ও বিভিন্ন সংগঠনকে সর্তক অবস্থায় রয়েছে।
অপরদিকে, বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপের প্রভাবে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং প্রভাব ফেলতে পারে সাতক্ষীরার উপকূলীয় অঞ্চলে। মঙ্গলবার সকালে ঘূর্ণিঝড় প্রভাব ফেলতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সাতক্ষীরা উপকূলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় মোট বেড়িবাঁধ আছে ৭০০ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৩৫ পয়েন্টে ২০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া উপকূলীয় জনপদের মৎস্য ঘেরগুলো বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে।
সাতক্ষীরা আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জুলফিকার আলী রিপন জানান, ঘূর্ণিঝড়টি এখনো বঙ্গোপসাগরে রয়েছে। মঙ্গলবার সকালে সাতক্ষীরা উপকূলে আঘাত হানতে পারে। ইতোমধ্যে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোর ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় এক নম্বর সতর্কতা সংকেত অবলম্বন করতে বলা হয়েছে। পরবর্তী সতর্ক সংকেত জানিয়ে দেওয়া হবে। সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড বিভাগ-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, সাতক্ষীরা উপকূলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতায় ৭০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে যার মধ্যে ২০০ কিলোমিটারের ৩৫টি পয়েন্ট ঝুঁকিপূর্ণ। ইতোমধ্যে আম্ফানে ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধগুলো সংস্কার করা হয়েছে। তাছাড়া বাকি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় দুর্যোগ মোকাবিলায় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আক্তার হোসেন বলেন, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের প্রভাবে সিত্রাং আঘাত আনতে পারে সাতক্ষীরা উপকূলে। শ্যামনগর উপজেলায় সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১০৩টি। এছাড়া স্কুল, কলেজ, মাদরাসাসহ অন্য পাকা ভবনে আশ্রয়কেন্দ্র রয়েছে ১৮০টি। এসব কেন্দ্রে প্রায় এক লাখ মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। তবে এ উপজেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩ লাখ। তাই পুরাপুরি সামাল দিতে বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
অপরদিকে, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘সিত্রাং’ এর কারণে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে ৩নং সতর্ক সংকেত থাকায় কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন সমুদ্রপথে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। রোববার দুপুর ২টার দিকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন জাহাজ মালিকদের সংগঠন স্কোয়াবের সভাপতি তোফায়েল আহমেদ। তিনি বলেন, বৈরি আবহাওয়ার কারণে জাহাজ চলাচল বন্ধের নির্দেশ দেন জেলা প্রশাসক। তাই আমরা জাহাজ চলাচল বন্ধ রাখার সিন্ধান্ত নিয়েছি। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ান জানান, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত সেন্টমার্টিন নৌ-পথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ থাকবে।
অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন জানান, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট গভীর নিম্নচাপটি গতকাল রোববার রাতে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে রূপ নিয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হতে পারে। গভীর নিম্নচাপটির বর্ধিতাংশ, অমাবস্যা তিথি ও বায়ুচাপ পার্থক্যে আধিক্যের প্রভাবে উপকূলীয় জেলায় বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাস হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, বরিশাল, ঝালকাঠি, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ ও শরীয়তপুর এবং জেলাগুলোর অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৫ থেকে ৭ ফুট উচ্চতার বায়ুতাড়িত জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে। তিনি বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের আগমনী বার্তায় চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, মোংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরগুলোকে ১ নম্বর দূরবর্তী সতর্ক সংকেত নামিয়ে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। গভীর নিম্নচাপটি ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেওয়ার পর সমুদ্র বন্দরগুলোতে সতর্ক সংকেত বাড়িয়ে দেওয়া হবে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের ৪৮ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ এখন ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার। যা দমকা অথবা ঝোড়ো হাওয়ার আকারে ৬০ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গভীর নিম্নচাপ কেন্দ্রের নিকটবর্তী এলাকায় সাগর উত্তাল রয়েছে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান জানান, ঘুর্ণিঝড় সিত্রাং দেশের উপকূলীয় ১৯টি জেলায় একযোগে আঘাত হানতে পারে। এখন যে পূর্বাভাস আছে ১৯টি (উপকূলীয়) জেলাই ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। গত ৩ বছরে যে ঘূর্ণিঝড়গুলো হয়েছে তার চেয়ে এটির আঘাত হানার এরিয়া অনেক বেশি। তিনি আরও বলেন, সর্বশেষ রিপোর্ট অনুযায়ী এর অবস্থান হলো ৮৮. ৫ দ্রাঘিমাংশ এবং ১৬ অক্ষাংশ। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, এটি ৮৭ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ এবং ১৭ ডিগ্রি অক্ষাংশের সংযোগস্থলে পৌঁছার পর সরাসরি উত্তর-পূর্ব দিকে টার্ন নিতে পারে। যদি উত্তর-পূর্ব দিকে টার্ন করে তাহলে যে গতিপথ দেখানো হয়েছে এটি একেবারে কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা উপকূলের সব ১৯টি জেলায় আঘাত হানতে পারে। তবে উত্তর-পশ্চিম দিকে যাচ্ছে, তাহলে এটি ভারতের ভুবনেশ্বর ও পশ্চিমবঙ্গে আঘাত হানবে। তিনি বলেন, যেভাবে ম্যাপিং করা হয়েছে একেবারে কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত আমাদের ৭৩০ কিলোমিটার উপকূল সম্পূর্ণরূপে আক্রান্ত হবে। এটা সুপার সাইক্লোন হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, এটা সিভিআর সাইক্লোন পর্যন্ত হবে। গতিবেগ হবে ঘণ্টায় ৯০ থেকে ১১০ কিলোমিটার। ’
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ বলেন, ঘূর্ণিঝড়টি পুরো বরিশাল বিভাগ এবং চট্টগ্রাম বিভাগের নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলার উপকূলে আঘাত হানতে পারে। আঘাতের সময় বাতাসের গতিবেগ থাকতে পারে ৯০-১১০ কিলোমিটার। রাতে অমাবশ্যার কারণে উপকূলীয় এলাকা ও চরাঞ্চলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৭ থেকে ১০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
