



#চন্দ্র নারায়ণ সাহা, রায়গঞ্জঃ পৌষ মাসের সংক্রান্তিতে বঙ্গজীবনে পিঠে, পুলি তৈরি এবং পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে পরিবেশন করাটাকে ঐতিহ্য হিসেবে মেনে নেওয়া হয়। সময় পরিবর্তনের প্রভাবে আজকাল পিঠে, পুলি তৈরি হলেও কমেছে তার ব্যপকতা। তবে প্রতি ঘরে শীতের মরশুমে পিঠে, পুলি বানানোর রীতি আজও প্রচলিত আছে। পৌষ সংক্রান্তির সৃষ্টি ও ব্যপকতা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত থাকলেও ভৌগোলিকদের মতে, পৌষ সংক্রান্তির দিন থেকে সূর্য ক্রমশই উত্তর মেরুর দিকে সরতে থাকে।
যার ফলে দিনের সময় বাড়তে থাকে, আর রাতের পরিমান ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এই পৌষ সংক্রান্তিকে অতি পবিত্র দিন হিসাবে মান্য হয়। অন্যদিকে, পুরাণ অনুযায়ী এই দিনেই দেবতাদের সঙ্গে অসুরদের যুদ্ধ শেষ হয়েছিল। শ্রীবিষ্ণু অসুরদের বধ করে তাঁদের কাটা মুন্ডু মন্দিরের পর্বতে পুঁতে দিয়েছিলেন। তাই মকর- সংক্রান্তির দিনই সমস্ত অশুভ শক্তির বিনাস হয়ে শুভ শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বলে আজও মানা হয়ে থাকে। এছাড়াও, মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের বিশ্ববিখ্যাত বীর, মহাপ্রাজ্ঞ, সর্বত্যাগী ও জিতেন্দ্রিয় মহাপুরুষ ভীষ্মের মহাপ্রয়াণের স্মৃতির জন্য উত্তরায়ণ সংক্রান্তি আরও মর্যাদাপূর্ণ হয়েছে।
উল্লেখ্য, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে কৌরবপক্ষের চারজন সেনাপতির মধ্যে তিনিই প্রথম সেনাপতি। উভয় পক্ষের ১৮ দিন যুদ্ধের ১০ম দিবসে সূর্যাস্তের কিছুক্ষণ পূর্বে পাণ্ডব পক্ষের সেনাপতি অর্জুনের শরাঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ভীষ্মদেব রথ থেকে মাটিতে পড়ে যান। কিন্তু তিনি মাটি স্পর্শ না করে আটান্ন দিন তীক্ষ শরশয্যায় শুয়ে উত্তরায়ণের অপেক্ষা করে পৌষ সংক্রান্তির দিনে যোগবলে দেহত্যাগ করেছেন। পুরানে আরও একটি জনপ্রিয় মত কথিত আছে। সেটি হল, মহারাজ সাগর তার অশ্বমেধের ঘোড়ার জন্য কপিল মুনির আশ্রমে গিয়ে তার সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে পরেন।
এরকম অবস্থায়, কপিল মুনির অভিশাপে রাজার ৬০ হাজার পুত্র ভষ্ম হয়ে যান। রাজা কান্নায় ভেঙ্গে পরে, তখন কপিল মুনি তাকে জানান, তার কোন বংশধর যদি গঙ্গাকে নিয়ে আসে, তাহলে তাদের শাপ মুক্তি হয়ে যাবে। পরে ভগীরত গঙ্গাকে নিয়ে এসেছিলেন এই জায়গায়। তারপর থেকেই এই দিনটি বিশেষ মাহাত্ম্য পেয়ে আসছে গঙ্গা সাগরে। সারা ভারতের ধর্মপ্রাণ মানুষেরা এখানে পুন্য স্নান করেন। প্রাচীন কাল থেকেই দেবতার পূজায় পিঠের অর্ঘ্য প্রদানের রীতি রয়েছে। মধ্যযুগে ধর্মপূজায় পিঠে নৈবেদ্যও দেওয়া হত।
তবে দেবতার পূজায় নিবেদনের জন্য বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রকার পিঠে প্রস্তুত করার বিধান রয়েছে। তবে গ্রীষ্মকালে পিঠেপুলি রুচিকর নয় বলে শীতকালেই এই জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বছরের বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত পিঠেপর্বের মধ্যে পৌষ সংক্রান্তির পৌষপার্বণই সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ। এই দিনটি হিন্দু পঞ্জিকায় ‘মকর সংক্রান্তি’ বা ‘উত্তরায়ণ সংক্রান্তি’ নামেও পরিচিত। প্রাচীনকালে হিন্দুরা এই দিনটিতে পিতৃপুরুষ অথবা বাস্তুদেবতার উদ্দেশ্যে তিল কিংবা খেজুড় গুড় দিয়ে তৈরি তিলুয়া এবং নতুন ধান থেকে উৎপন্ন চাল থেকে তৈরি পিঠের অর্ঘ্য প্রদান করতেন। এই কারণে পৌষ সংক্রান্তির অপর নাম তিলুয়া সংক্রান্তি বা পিঠে সংক্রান্তি।
পৌষ সংক্রান্তি বা মকর সংক্রান্তি একটা ফসলী উৎসব যা শুধু দক্ষিণ এশিয়ায় পালিত হয়। ভারতে পৌষসংক্রান্তি নামেই, বাংলাদেশে এর নাম সাকরাইন, নেপালে এটা পরিচিত মাঘি নামে, থাইল্যান্ডে সংক্রান, লাওসে পি-মা-লাও, মিয়ানমারে থিং-ইয়ান এবং কম্বোডিয়ায় মহাসংক্রান নামে পরিচিত। মকর সংক্রান্তি হল সেই ক্ষণ যাকে ঘিরে এই উৎসব পালিত হয়।
