News Britant

মায়াময় এক উপাখ্যান, ইন্দুবালা ভাতের হোটেল

Listen

( খবর টি শোনার জন্য ক্লিক করুন )

#দেবলীনা ব্যানার্জী: সময় বয়ে যায়, মানুষ চলে যায়, পড়ে থাকে স্মৃতিগুলো, কেউ কি কখনো থেকেছে? মানুষের জীবনের চরম সত্য ও একটাই প্রশ্ন যে এটাই। এই প্রতিদিনের জীবনে এত যে চাওয়া পাওয়া কোনোটাই শেষ পর্যন্ত থাকে না। যে বা যারা চলে যায় তারা কখনোই ফিরে আসে না। সেই মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করতে যাওয়া ছেলেটা, সেই নকশাল করা ছেলেটা, সেই বাংলাদেশ ছেড়ে কলকাতায় বিয়ে হয়ে আসা ছোট্ট মেয়েটা, কিংবা তাড়াহুড়ো করে রেললাইন পার হতে যাওয়া সেই দাপুটে মাছওয়ালি কেউ ফেরে না।

“ঘরে আর ফিরবে না কেউ, কথা দিলাম, কথা দিলাম”, তাই এত দাগ কেটে যায় মননে। দেবালয় ভট্টাচার্য তাঁর সিরিজে গানের ব্যবহার নিয়ে বরাবরই প্রচন্ড খুঁতখুঁতে। তাঁর সিরিজ বা ছবি মানেই দুর্দান্ত কিন্তু গান পাওয়া যাবে ধরে নেওয়াই যায়। ব্যাতিক্রম নয় ইন্দুবালাও। পাখিদের স্মৃতি, শূন্য এ বুকে গানগুলো সিরিজে যখনই আসে এক অপূর্ব অনূভুতি চোখের কোল বেয়ে নেমে আসে। গানগুলো এই সিরিজের সবচেয়ে বড় শক্তি।

কখনো কখনো মনে হয়েছে সবকটা গানই একসাথে মিলেমিশে একটাই সুতো হয়ে হতভাগিনী ইন্দুবালার জীবনের টুকরো টুকরো ঘটনাগুলো গেঁথে রেখেছে। গল্প বলার ধরণটাও ভারী সুন্দর। তিনটে টাইমলাইনের তিন-তিনটে গল্প সমান্তরালভাবে এগিয়েছে, একটা টাইমলাইন থেকে অন্য টাইমলাইনে সুইচ করার দৃশ্যগুলো ভীষণ মসৃণ। সমকালীন কলকাতার ছবি সিনেমা হল ও বেশ্যাবাড়ির একটি কক্ষেই সীমাবদ্ধ হলেও গ্ৰামের দৃশ্যগুলো যত্ন নিয়ে শুট করা হয়েছে।

গাছের ওপর মনিরুলের বাঁশি বাজানো, ঘোর বৃষ্টিতে কচুবনের দৃশ্যগুলো আলাদা মায়ার জন্ম দেয়। অভিনয় সকলেরই ভালো। লছমির চরিত্রে স্নেহার ওপর থেকে তো চোখই সরানো যাচ্ছিলো না। যুবতী ইন্দুবালার চরিত্রে শুভশ্রীর অভিনয় কোথাও কোথাও ফ্ল্যাট লেগেছে। কিন্তু স্বামীর হাতে অত্যাচারিত হওয়ার পর পাগলের মতো গপগপ করে ভাইয়ের আনা মালপোয়া আর আমতেল খাওয়ার দৃশ্যে উনি সফল, বুক মুচড়ে উঠেছিলো ভয়ানক। ইন্দুবালার স্বামীর চরিত্রে প্রতীক দত্তের অভিনয় কলকাত্তাইয়া বাবু কালচারের সেই সময়কে নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছে।

প্রতীকের অসাধারণ অভিনয় নিয়ে খুব কম আলোচনা সম্ভবত চরিত্রটির নেগেটিভ অবতারের জন্য। গা জ্বালানো হাসি ও দৃষ্টি সমেত এই চরিত্রটি দর্শকের ঘৃণার জায়গায় স্থায়ী আসন পেতে রাখে। ভুলতে পারিনি মৃত্যুর আগের মূহুর্তে হাঁটু গেড়ে বসে সুহোত্রর সেই বুকে শেল বেঁধানো দৃষ্টি। আবার যখন ধরেই নিয়েছি এই গল্প শুধু ইন্দুবালার, তখন শেষ এপিসোডে ঝড়ের মতো এসে উড়িয়ে দিয়েছেন রাহুল বন্দ‍্যোপাধ্যায়, যখন কান্নাভাঙ্গা গলায় তিনি বলে ওঠেন, মায়ের মত তার কোনো নিজের দেশ নেই, ঘর নেই, শৈশবের সুন্দর স্মৃতি নেই, সব তেতো, তখন যেন এই কংক্রিটের শহরের একফালি ফ্ল্যাটে বেড়ে ওঠা বর্তমান প্রজন্মের সাথে খুব সহজে মিলিয়ে ফেলি ইন্দুবালার ছোট ছেলেকে।

আর শুভশ্রী বুঝিয়ে দিয়েছেন এই মূহুর্তে অভিনেত্রী হিসেবে তিনিই বাংলা ছবির প্রধান মুখ হওয়ার দাবি রাখেন। বৃদ্ধা ইন্দুর মেকআপ নিয়ে কিছু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে, আমি সেসবের বোদ্ধা নই তাই বলা কঠিন, কিন্তু আমার যুবতী ইন্দুর চেয়ে বৃদ্ধা ইন্দুর চরিত্রে শুভশ্রীর অভিনয়, চাহনি, হাঁটাচলা একদম একশোয় একশো মনে হয়েছে। কিশোরী ইন্দুর চরিত্রে পারিজাত ও খুব মিষ্টি, বিশেষত পারিজাতের মুখের ওপার বাংলার ভাষা যেন কানে মধু ঝরাচ্ছিলো। শেষে সিরিজ থেকে ইন্দুর মুখের কথা ধার করেই বলি, ইন্দুবালাদের জীবনে কাউকে কোনোদিন লাগেনি, লাগবেও না, ইন্দুবালারা নিজেরাই সবটা করতে পারে।

Leave a Comment

Also Read