News Britant

ঘূর্ণিঝড় মোচা আতঙ্কে বাংলাদেশের উপকূলবাসী

Listen

( খবর টি শোনার জন্য ক্লিক করুন )


#হাবিবুর রহমান, ঢাকা: বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় মোচা আঘাত হানতে পারে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। আবহাওয়া দপ্তরের এ পূর্বাভাসে উপকূলীয় এলাকায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। ঘূর্ণিঝড় সিডর, আইলা, মহাসেন, বুলবুলের আঘাতের ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, বটিয়াঘাটা এলাকার মানুষ। এর মধ্যেই আবহাওয়া অধিদপ্তর আভাস দিয়েছে, আগামী ১৩-১৫ মের মধ্যে উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘মোচা’। সরকারের পক্ষ থেকে সকল প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ের গতিবিধি লক্ষ্য করে প্রয়োজনীয় উপকূলীয় এলাকার মানুষদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তুতিও রয়েছে স্থানীয় প্রশাসনের।

জানা গেছে, বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় এলাকায় মৌসুমি বৃষ্টিপাত শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগের খবরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে উপকূলীয় এলাকায়। প্রতি বছরই দূর্যোগের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হন উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দারা। উপকূলীয় উপজেলা শ্যামনগরের বুড়িগোয়ালীনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ভবতোষ কুমার মন্ডল জানান, শনিবার থেকেই উপকূলীয় অঞ্চলে থেমে থেমে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হয়েছে। নদ-নদীর পানি স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে এই এলাকার মানুষ জরাজীর্ণ বেঁড়িবাধ নিয়ে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। ভারী বর্ষণ আর জোয়ারের পানি বেড়ে গেলে এই বাঁধগুলো কত সময় টিকে থাকবে তা নিয়ে আশঙ্কায় রয়েছেন স্থানীয়রা।

রহিমা বেগম নামে উপকূলের এক নারী জানান, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর রাতের ঘূর্ণিঝড় সিডর কেড়ে নেয় পটুয়াখালীসহ উপকূলীয় জেলার ৬৭৭ জনের প্রাণ। লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় ৫৫ হাজার ঘরবাড়ি। সিডরে বিধ্বস্ত হয় জেলার ৯০০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ ও রাস্তাঘাট। এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জের চরখালী, গোলখালী, লোহালিয়া, পায়রাগঞ্জ, লাউকাঠীসহ উপকূলবাসী। শুধু মানুষই নয়, গৃহপালিত পশু-পাখি ও বন্যপ্রাণীও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষ আজও সেই দুর্বিষহ স্মৃতি বহন করে চলেছেন। জেলাগুলোর কয়েক হাজার বাড়িতে সৃষ্টি হয়েছিল শোকাবহ পরিবেশ, ঝড়ে এইদিনে আপনজনদের হারিয়ে ফেলেছেন তারা। কেউ কেউ বেঁচে গেলেও এই দিনটি হয়ে ওঠে এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন। হাজার হাজার মানুষ শরীরের বিভিন্ন স্থানে বয়ে বেড়াচ্ছেন এইদিনে পাওয়া আঘাতের ক্ষত। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পর নদীতে বিলীন হয়ে যায় ভিটামাটি।

স্থায়ী মেরামত না হওয়ায় এখনো সেখানে জোয়ার ভাটা চলছে। তিনি বলেন, ‘এখানোও শান্তিতে নেই। গেলো কয়েক বছরে ফণী, বুলবুল, আম্পানসহ একের পর এক ঘূর্ণিঝড়ে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আশ্রয়স্থলটি। শুনলাম আবার নতুন ঝড় আসবে এতে আবারও ক্ষয়ক্ষতির শঙ্কায় আছি। ‘ঝড় এলেই সবাই সাইক্লোন শেল্টারে যেতে বলে। কিন্তু বাড়িতে হাস, মুরগি, গরু, ছাগল ফেলে রেখে যেতে পারি না। অনেক সময় জীবন বাজি রেখে বাধ্য হয়ে বাড়িতে পড়ে থাকতে হয়।’ খুলনার ভাঙনকবলিত কয়রা, পাইকগাছা ও দাকোপ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লবণাক্ততা এবং প্রচণ্ড গরমে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। বালুযুক্ত এসব বাঁধে বৃষ্টির পানি পড়লেই তা গলে যেতে শুরু করে। যে কারণে জোয়ারের পানির চাপ বাড়লে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

এলাকাবাসী বলছেন, বাঁধ ভাঙলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে ধানের। কারণ এখনো মাঠে বোরো ধান রয়েছে। কৃষকরা চেষ্টা করছেন দ্রুততার সঙ্গে ধান কেটে বাড়িতে আনার জন্য। কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের বাসিন্দা আছের আলী মোড়ল ও শোয়েব আক্তার বলেন, জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষা পেতে নদীরক্ষার বাঁধগুলো বছরের প্রায় সময় অরক্ষিত থেকে যায়। তবে ঘূর্ণিঝড় আঘাত করলে তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে নদ-নদীগুলোর পানি বাড়তে থাকে। এতে জোয়ারের চাপও বেড়ে যায়। তখন বাঁধগুলো টিকে থাকতে পারে না। জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে কয়রা উপজেলার ৬ নম্বর কয়রা, ৪ নম্বর কয়রা রিং বাঁধ, ঘাটাখালী, হরিণখোলা, মদিনাবাদ লঞ্চঘাটসংলগ্ন এলাকা, মঠবাড়িয়া, ২ নম্বর কয়রা, হোগলা, গাজীপাড়া, গোলখালী, হাজতখালী, জোড়শিং ও মহেশপুর এলাকার প্রায় ১২ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে নদীতে পানি বাড়লে ওই এলাকার বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ উপচে অথবা ভেঙে গিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশের আশঙ্কা রয়েছে।

উত্তর বেদকাশী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, আমাদের গাতিরঘেরী এলাকায় গতবছর একাধিকবার বাঁধ ভেঙেছে। দীর্ঘমেয়াদি কোনো পরিকল্পনা এখানে বাস্তবায়ন না হওয়ায় বাঁধ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। মহেশ্বরীপুর ইউপির চেয়ারম্যান শাহনেওয়াজ শিকারি বলেন, তার এলাকায় একাধিক স্থানে বাঁধ ধসে গেছে। নদীতে জোয়ারের পানির চাপ বাড়লে বড় ক্ষতি হতে পারে। বাঁধ ভাঙলে গোটা ইউনিয়ন নদীর লবণাক্ত পানিতে তলিয়ে যাবে। তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের স্থায়ী সমাধানের দাবি জানিয়ে এলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। বাঁধ স্থায়ী করতে হলে নদী শাসনের কোনো বিকল্প নেই।

খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সালাউদ্দিন বলেন, আমাদের আওতাধীন মোট ৬৩০ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ১০ কিলোমিটার। আর অতিঝুঁকি পূর্ণ তিন কিলোমিটার। এর মধ্যে কয়রা উপজেলাকে বেশি নজরদারিতে রাখতে হচ্ছে। তিনি বলেন, কপোতাক্ষ নদ ও সাকবাড়িয়া নদী পরিবেষ্টিত সুন্দরবন সংলগ্ন এ উপজেলায় একটু জলোচ্ছ্বাস হলে ভালো বাঁধও নদীতে বিলীন হয়ে যায়। বাড়িঘর তলিয়ে যায় নোনাপানিতে। দাকোপ উপজেলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ আবুল হোসেন বলেন, কয়রার মতোই তার উপজেলায় নদীভাঙন অনেক বেশি। উপজেলার জালিয়াখালী, মধ্যপানখালী, কালাবগী, সুতারখালী, চুনকুড়ি, ঢাংমারি, জাবেরের খেয়াঘাট, খোনা, গড়খালী, মোজামনগর, ঝালবুনিয়া, দক্ষিণ কামিনিবাসিয়া, উত্তর কামিনিবাসিয়া, বটবুনিয়া, শিবসার পাড়, ভিটেভাঙ্গা, শ্রীনগর, কালীবাড়ি, গুনারী, খলিশা এলাকায় বাঁধ ঝুকিপূর্ণ রয়েছে। তিনি বলেন, এ এলাকাগুলোতে স্থায়ী বাঁধ দেওয়ার জন্য বিভিন্ন সময়ে চেষ্টা করেও তা সম্ভব হয়নি।

দাকোপের কামারখোলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পঞ্চন কুমার মন্ডল বলেন, তার ইউনিয়নে একাধিকবার নদী ভাঙন হয়েছে। আইলা আর সিডরে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে এলাকাবাসীর। দুর্বল বেড়িবাঁধের মধ্যে কোনো রকমে মানুষ টিকে রয়েছেন। আবার যদি ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস হয় তাহলে আবারও ক্ষতি হবে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ভাঙনের পর পাউবো তড়িঘড়ি করে বাঁধ মেরামত করে। কিন্তু তা স্থায়ী কোনো সমাধান বয়ে আনে না। জোয়ারের পানির চাপে বাঁধ ভেঙে যায়। তিনি জানান, তার ইউনিয়নে অন্তত ১০টি স্থান ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। খুলনা পানি উন্নয়ন বোর্ড-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুর রহমান আজরিয়া বলেন, আমাদের আওতাধীন মোট ৩৭৯ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ছয় কিলোমিটার। আর অতিঝুঁকিপূর্ণ তিন কিলোমিটার।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মো. এনামুর রহমান বলেছেন, সাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হলেই সরকারের পক্ষ থেকে সকল প্রস্তুতি শুরু হবে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পূর্বাভাস কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। ঝুঁকিপূর্ণ জেলাগুলোকে আগাম প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব জেলা প্রশাসকদের সঙ্গে আমাদের ভার্চুয়ালি মিটিং হয়েছে।

Leave a Comment

Also Read