News Britant

কুলিক নদীর কাদা পথে : চন্দ্র নারায়ন সাহা (পঞ্চম পর্ব )

Listen

( খবর টি শোনার জন্য ক্লিক করুন )

কুলিক নদীর তীরে আমাদের দেখার সমস্যা

প্রাথমিকভাবে আমরা স্থানীয় মানুষদের থেকে যে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করেছিলাম, সেগুলিকে স্বচক্ষে দেখে নিতে আমাদের এই অভিযান সংঘটিত হয়েছিল। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার লেখালেখি ছাড়াও আমরা স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে কথা বলে নিম্নলিখিত সমস্যাগুলি চিহ্নিত করেছি:-
১. শ্মশান:
আমাদের চলার পথে স্থায়ীভাবে পাঁচটি শ্মশানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছি। এই শ্মশান গুলির প্রত্যেকটি নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। স্বাভাবিকভাবেই শ্মশানের কাজকর্মের শেষে চিতার অবশিষ্টাংশ নদীর জলে নিক্ষিপ্ত হয়। ছড়ায় দূষণ। সারাবছর নদীর জলের চলার বেগ প্রায় শূন্য থাকায় সেই দূষণ স্থানীয় জৈব বৈচিত্র কে সরাসরি প্রভাবিত করে।


২. উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার:
বাড়তি জনসংখ্যার চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে প্রতিটি কৃষিজমিতে আধুনিক উচ্চ ফলনশীল বীজের ব্যবহার লক্ষ্য করেছি। এই বীজের ব্যবহারের ফলে, কৃষককে একদিকে যেমন বেশি পরিমাণে জলসেচ করতে হয়, তেমনি অপর দিকে বেশি পরিমাণে কীটনাশক ব্যবহারের ফলে জমির উর্বরতা শক্তি কমে যায়।
৩. রাসায়নিক সারের ব্যবহার:
জমিতে উচ্চ ফলনশীল বীজ ব্যবহারের পূর্বশর্ত স্বরূপ রাসায়নিক সারের ব্যবহার বাধ্যতামূলক। আর তাই, কৃষি জমিতে নাইট্রোজেন, ফসফেট, ইউরিয়া প্রভৃতি সকল নানারকম রাসায়নিক সার ব্যবহৃত হয়। এই রাসায়নিক সারের কিছু অংশ দিনের-পর-দিন কৃষিজমি ধুয়ে নদীতে এসে মেশে। ফলে নদীর জল বিষাক্ত হয়ে পড়ছে।

৪. River Lifting:
উচ্চ ফলনশীল বীজ ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে একদিকে যেমন প্রচুর পরিমাণে জলসেচ করতে হয়, তেমনি মৌসুমি জলবায়ুর খামখেয়ালিপনার কারণেও প্রতিবছর সুখা মরসুমে জলসেচ করতে হয়। নদী তীরবর্তী কৃষিজমি গুলোতে সরাসরি সরকারিভাবে বেসরকারিভাবে নদী থেকে জল তুলে কৃষি জমিতে দেওয়ার প্রবণতা দেখেছি। এক্ষেত্রে সরকারি নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে, অতিরিক্ত জল তুলে নেওয়ার কারণেও নদীটিতে বহন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং নদীর বুকে পলি জমে নদীখাত ভরাট হয়ে উঠেছে।
৫. অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষচ্ছেদন:
নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে মানুষের ব্যক্তিগত বা সামাজিক প্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিত বৃক্ষচ্ছেদন এর কর্মকান্ড আমরা লক্ষ্য করেছি। এতে একদিকে যেমন মাটির ক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে। মৃত্তিকা ক্ষয় বেড়ে যাওয়ায় নদীখাত ভরাট হচ্ছে এবং নদীর জল পরিবহন ক্ষমতা কমছে।


৬. মৃত পশু পাখির দেহের ভাগাড়:
নদীর তীরবর্তী বেশ কয়েকটি অঞ্চল ঘনবসতিপূর্ণ। সেই জনগোষ্ঠীতে কোন গৃহপালিত পশু বা কোন প্রাণী মারা গেলে, তাদেরকে নদীর জলে বা নদীর পাড়ে ফেলে দেওয়ার প্রবণতা আমরা দেখেছি। এর ফলস্বরূপ নদীর জলে দুর্গন্ধ ছড়ানোর পাশাপাশি মহামারীর প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।


৭. ডাম্পিং গ্রাউন্ড:
পথ চলতে চলতে আমরা পৌছালাম রায়গঞ্জ শহরের কাছে। দেখলাম, পৌরসভার পক্ষ থেকে শহরের সমস্ত বর্জ্য পদার্থ খোলা আকাশের নিচে, কুলিক নদীর পাড়ে জমা করা হচ্ছে। চিকিৎসা সংক্রান্ত আবর্জনা থেকে শুরু করে সমস্ত রকমের জঞ্জাল দিনের পর দিন এই অংশে জমা করা হচ্ছে। এতে একদিকে যেমন সেই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাপন করা কষ্টকর হয়ে উঠেছে, তেমনি ওই আবর্জনা ধুয়ে যাওয়া জল নদীতে বিষ ক্রিয়া সৃষ্টি করছে বলে মনে করা হয়। এতে সরাসরিভাবে নদী জলের বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হচ্ছে এবং জলের পিএইচ এর মানে তারতম্য ঘটছে।
৭. মাটিচুরি:
সরকারিভাবে কুলিক নদীর 12 নম্বর জাতীয় সড়কের আশেপাশে 300 মিটার এর মধ্যে বালু বা অন্য কোন পদার্থ নদীর বুক থেকে তোলার নিষেধাজ্ঞা থাকলেও নদীর বুক থেকে মাটি চুরির প্রচুর ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। নদীরপাড় কেটে মাটি তোলার এই প্রবণতা রায়গঞ্জ শহর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বেশি। তবে স্থানীয় কুমোর শিল্পীরা তাদের প্রয়োজন মতো মাটিও এই নদীর জল কমে গেলে সংগ্রহ করে থাকেন বলে আমাদের সমীক্ষায় ধরা পড়েছে।


৯. বহিরাগত মাছের বাক্স:
স্থানীয় কুলিক ব্রিজের ঠিক নিচে বহিরাগত মাছের প্যাকিং বাক্স গুলি এবং তাকে শীতলীকরণ এর কাজে ব্যবহৃত কাঠের গুঁড়ো, থারমো কল এবং ফরমালিন প্রভৃতি রাসায়নিক পদার্থ এই অঞ্চলে কোন বাধা নিষেধ ছাড়াই ফেলে রাখা হচ্ছে। এর ফলে ধীরে ধীরে ওই অবাঞ্ছিত পদার্থসমূহ নদীর জলে মিশে গিয়ে বিক্রিয়ার পাশাপাশি থারমো কল গুলি নদীতে আবর্জনা সৃষ্টি করে। যদিও বর্তমানে রায়গঞ্জ পৌরসভা ওই অঞ্চলে ব্যারিকেড তৈরি করে নদীর জলে থারমো কল ফেলার নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।


১০. পলিব্যাগ:
প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ এর ব্যবহার দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ব্যবহারের পর পলিব্যাগ গুলি অজ্ঞতার কারণে যত্রতত্র ফেলে দেয়া হচ্ছে। এগুলি গিয়ে কুলিক নদী তে জমা হয়ে ভেসে যেতে দেখেছি। চার দিন ধরে আমাদের চলার পথে আমরা প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক ক্যারি ব্যাগ নদীবক্ষে ভেসে যেতে দেখেছি। কিছু পরিমাণ প্লাস্টিক আমরা সেই সময়ে তুলতে পেরেছি ঠিকই, তবে এই ক্যারিব্যাগ গুলি যে নদীর চলার পথকে রুদ্ধ করে, সে বিষয়ে আমরা অনেকটাই নিশ্চিত।
১১. পিকনিক:
কেশবপুর থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি জায়গায় দেখেছি নদীর পাড়ে রান্না করার জন্য উনুন তৈরি করা আছে। এই উনুন গুলি শীতকালে পিকনিক করার সময় ব্যবহৃত হয়। ইটভাটায় যারা কাজ করে, এই উনুন গুলি তাদেরও তৈরি করা হতে পারে। অথবা জেলে হিসেবে যারা মাছ ধরতে যায়, তাদেরও হতে পারে। তবে এই উনুনের পাশাপাশি অঞ্চলে প্লাস্টিক জলের বোতল, থার্মোকলের থালা বাটি পড়ে থাকতে দেখে আমাদের ধারণা- এই দূষণ গুলি পিকনিক পার্টিরই কাজ।


১২. যানবাহন ধোয়া:
কুলিক ব্রিজ সংলগ্ন এলাকা সহ বেশ কিছু জায়গায় ডিজেল বা পেট্রোল চালিত গাড়ি গুলি কলিকের জলে ধোয়া হচ্ছে। এই গাড়ি ধোয়ার সাথে সাথে গাড়ির পোড়া মোবিল সহ নানা রকম পেট্রোলিয়াম জাতীয় পদার্থ গুলি জলে গিয়ে মিশে যাচ্ছে এবং জলের উপরে ভেসে থেকে একপ্রকার অস্বাস্থ্যকর নদীর জল তৈরি করছে। এই নোংরা জল জলজ জীব বৈচিত্র কে ধ্বংস করছে।
১৩. ইউট্রোফিকেশন:
স্থানীয় কৃষি জমিতে যে হারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার দেখলাম, তার ফলস্বরূপ সেই রাসায়নিক ধুয়ে আসা বৃষ্টির জল নদীর জলে মিশে জলের পুষ্টি স্তর বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিনাম স্বরূপ, নদীর জলে এমন কিছু আগাছা ও শৈবাল জন্ম নিচ্ছে, যা নদীর জলে আগে দেখা যেত না। ইউট্রোফিকেশন এর ফলেই নদীর জলের নিম্ন অববাহিকায় কচুরিপানা, শ্যাওলা, ফাঙ্গীর মতো জলজ উদ্ভিদের অবস্থান আমরা লক্ষ্য করেছি।


১৪. কুলিক এর গভীরতা হ্রাস:
কুলিক নদীর তীরের বাসিন্দা অতীন্দ্র রাম বকশি র সাথে কথা বলে জানা গেল, এই নদীর পূর্বের ও বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে। তার কথায়, এক সময় এই নদীতে সারা বছর জলের সরবরাহ থাকলেও বর্তমানে এর গভীরতা বেশ কমে গিয়েছে। পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে ধুয়ে আসা পলি এই নদীর গভীরতা কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। এছাড়াও নদীর গতি শ্লথ হওয়ার কারণে বাহিত পলি রাশি বহন করার ক্ষমতাও কমে গেছে। ফলে নদীগর্ভ দিনের-পর-দিন ভরাট হয়ে উঠেছে।
১৫. পয়: প্রণালীর জল:
রায়গঞ্জ শহর ও শহরতলীর আশেপাশে যে সমস্ত ক্ষুদ্র শিল্প কারখানা আছে, সেগুলির যাবতীয় নোংরা জল এই নদীতে নিয়মিত ফেলা হয়। এই পয়ঃপ্রণালী তে একদিকে যেমন শহরের ঘর গৃহস্থালী র ময়লা জল নদীতে গিয়ে মেশে, তেমনি ক্ষুদ্র কল-কারখানার রাসায়নিক মিশ্রিত নোংরা জল গিয়ে নদীতে মেশে। এতে নদীর জল দূষণ দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নদীর নিজস্ব বাস্তুতন্ত্র বিঘ্নিত হচ্ছে।


১৬. ইটভাটা:
নদীর তীরে বেশ কয়েকটি ইটভাটার অবস্থান আমরা লক্ষ্য করেছি। এই ইটভাটার অপরিপক্ক বা বেশি পুড়ে যাওয়া ইটের টুকরো গুলি নিয়মিত নদীর বুকে নিক্ষেপ করার প্রবণতা আমরা লক্ষ্য করেছি। এতে নদীর বোঝা বাড়ছে এবং নদীর নিজস্ব চলার ছন্দ নষ্ট হচ্ছে।
১৭. ইলেকট্রিক শক দিয়ে মাছ ধরা:
আব্দুল ঘাটা সন্নিহিত এলাকায় এবং শিয়াল মনী সংলগ্ন এলাকায় ছোট ছোট জেলেরা জলে ইলেকট্রিকের তরঙ্গ তৈরি করে মাছ ধরেন বলে আমরা শুনেছি। এই বৈদ্যুতিক তরঙ্গের আঘাতে নদীর জলে বসবাসকারী অন্যান্য প্রাণী গুলির মত মাছেদের জীবনচক্র প্রভাবিত হয়।

সমস্ত প্রতিবেদনের ঋণ স্বীকার শেষ পর্বে দেওয়া হবে।

News Britant
Author: News Britant

Leave a Comment